মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্রোহীদের অগ্রযাত্রা, নজর রাখছে চীন ও ভারত

মিয়ানমারের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্য দখলের দ্বারপ্রান্তে আরাকান আর্মি (এএ)। এই ক্ষমতার পরিবর্তনে দেশটির চলমান গৃহযুদ্ধ এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির হিসাবনিকাশও নতুন করে বদলে যেতে পারে।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দেশের অন্যান্য অংশে হারানো এলাকা পুনরুদ্ধার করলেও, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এবং বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত রাখাইনের ১৭টি শহরের মধ্যে ১৪টির নিয়ন্ত্রণ এখন আরাকান আর্মির হাতে।
সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিজয়ে উজ্জীবিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি এখন রাজ্যের বাকি অংশও দখলের ঘোষণা দিয়েছে। তাদের লক্ষ্যের মধ্যে আছে রাজধানী সিতওয়ে, ভারতের সহায়তায় নির্মিত একটি বন্দর এবং চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' উদ্যোগের অংশ কিয়াউকফিউ গভীর সমুদ্র বন্দর। বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের আক্রমণ চালানোর জন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির সামনে এখন দারুণ সুযোগ।
তবে আরাকান আর্মির এই লড়াই তীব্র মানবিক সংকটের মধ্যেই চলছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর তাদের চালানো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাখাইনে রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় সংকট আরও গভীর হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ২০ লাখের বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানায়, মধ্য রাখাইনের ৫৭ শতাংশ পরিবার এখন তাদের মৌলিক খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারছে না, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৩৩ শতাংশ। হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক সিতওয়ে শহরে আটকা পড়েছে। সেখানে এখন কেবল আকাশ ও সমুদ্রপথে যাতায়াত করা যায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। যেমন, যে শুকরের মাংসের দাম আগে ২ ডলার ছিল, তা এখন ১৩ ডলার ছাড়িয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানায়, হতাশায় মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, পরিবারগুলো ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির কারণে দিনের বেলায়ও চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটছে।
সম্প্রতি বিমানযোগে সিতওয়ে ছেড়ে আসা এক বাসিন্দা বলেন, "সন্ত্রাসীরা দিনের বেলাতেই ঘরে ঢুকে পড়ছে। এমনকি বাড়ির আসবাবপত্রও নিয়ে যাচ্ছে।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিতওয়ের এক সূত্র আল জাজিরাকে জানায়, সামরিক বাহিনীর সহযোগী সশস্ত্র গোষ্ঠী 'আরাকান লিবারেশন আর্মি' স্থানীয়দের কথাবার্তার ওপর কড়া নজর রাখছে। সেনারা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছে এবং আরাকান আর্মির সমর্থক সন্দেহে অনেকের শরীরে ট্যাটু খুঁজছে। ওই সূত্রটি বলে, "পরিস্থিতি খুবই অনিশ্চিত। সামনে কী ঘটবে, তা অনুমান করা কঠিন।"
আরাকান আর্মির রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের (ইউএলএ) একজন প্রতিনিধি সিতওয়েকে সামরিক শাসনের "একটি জ্বলন্ত উদাহরণ" হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, শাসকরা কয়েক দশক ধরে "আরাকানকে একটি দখলকৃত ভূখণ্ড" হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু বাড়ছে
রাখাইনজুড়ে আরাকান আর্মির অগ্রযাত্রার মুখে সামরিক সরকার বিমান হামলা বাড়িয়েছে। ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর থেকে তারা দেশজুড়েই এই কৌশল ব্যবহার করছে।
ইউএলএ জানায়, রাখাইনে ২০২৩ সালের শেষ থেকে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিমান হামলায় ৪০২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়, যাদের মধ্যে ৯৬ জনই শিশু। এ ছাড়া, কামান, স্থলমাইন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে এই বছর আরও ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায়।
ইউএলএ-এর একজন প্রতিনিধি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বিমান হামলাকে "সন্ত্রাসবাদ" আখ্যা দিয়ে বলেন, এ ধরনের কৌশল দিয়ে "কোনো সামরিক সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়"। উল্লেখ্য, ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে লড়াইয়ে আনুমানিক ৮০,০০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

চলমান এই সংঘাতের মধ্যে নিজেদের সেনাবল বাড়াতে আরাকান আর্মি এবং সামরিক বাহিনী উভয়ই সাধারণ মানুষকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করছে। আরাকান আর্মি তাদের "জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের" জন্য ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী পুরুষ এবং ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী নারীদের দলে নিচ্ছে। অন্যদিকে, সামরিক বাহিনীও গত ১৬ মাসে প্রায় ৭০,০০০ পুরুষকে সেনাবাহিনীতে যুক্ত করেছে।
রাখাইনে জাতিগত সহিংসতার ইতিহাস দীর্ঘ। ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনীর নৃশংস অভিযানে ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। সেই ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে এবং এর বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে চলছে। এখনো ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে শরণার্থী শিবিরে বাস করছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৮ মাসে নতুন করে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।
এদিকে, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধেও রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে। গত বছর ৬০০ জনকে গণহত্যার একটি অভিযোগ উঠলেও আরাকান আর্মি তা অস্বীকার করে। তাদের দাবি, মানুষের দেহাবশেষের ছবিগুলো আসলে যুদ্ধে নিহত সরকারি সৈন্যদের।
বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক শাখা ইউএলএ-এর দাবি, তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় "মুসলিম বাসিন্দারা" "সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো আছে"। ইউএলএ এবং সামরিক সরকার উভয়ই "রোহিঙ্গা" শব্দটি এড়িয়ে চলে। এর মাধ্যমে তারা বোঝাতে চায় যে, এই সম্প্রদায় রাখাইনের আদিবাসী নয়।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে যখন সামরিক বাহিনী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়তে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সদস্যদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালানোর পর এটি একটি নাটকীয় পরিবর্তন।
আন্তর্জাতিক সংকট গোষ্ঠী (আইসিজি) সতর্ক করে, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। তবে আইসিজি-র প্রতিবেদনে বলা হয়, "আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহ সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।" এতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা-বিরোধী মনোভাব আরও বাড়তে পারে এবং প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বাংলাদেশের সঙ্গেও উত্তেজনা বাড়ছে। বাংলাদেশ চায়, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের নিয়ন্ত্রক আরাকান আর্মি যেন শরণার্থীদের তাদের এলাকায় ফিরিয়ে নেয়। অন্যদিকে, আরাকান আর্মি আশঙ্কা করে, বাংলাদেশ রাখাইনে একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিতে পারে, যা তাদের জন্য হুমকি।
চীন নির্মিত বন্দরের জন্য লড়াই
সিতওয়ের দক্ষিণে কিয়াউকফিউকে কেন্দ্র করে একটি বড় লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এই উপকূলীয় কেন্দ্রটি চীনের ইউনান প্রদেশকে তেল-গ্যাস পাইপলাইন এবং একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে যুক্ত করেছে, যা চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পের অংশ।
প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রকাশনা জেনস-এর বিশ্লেষক অ্যান্থনি ডেভিস মনে করেন, আরাকান আর্মি সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের মধ্যে বর্ষার সময় আক্রমণ শুরু করতে পারে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ তাদের সামরিক বিমান হামলা থেকে বাঁচাবে এবং কিয়াউকফিউ দখলের সম্ভাবনা বাড়াবে। ডেভিস বলেন, আরাকান আর্মির কাছে থাকা অস্ত্রের মজুত ২০২৬ সাল নাগাদ কমে যেতে পারে। তাই তারা এখনই আক্রমণ করতে চাইছে।
তার মতে, প্রায় ৩,০০০ সরকারি সৈন্য কিয়াউকফিউ রক্ষা করছে, যাদের পেছনে রয়েছে যুদ্ধবিমান, ড্রোন এবং নৌবাহিনীর সমর্থন। অন্যদিকে, আরাকান আর্মির সেনাসংখ্যা এখন প্রায় ৪০,০০০। তারা কিয়াউকফিউ আক্রমণে প্রায় ১০,০০০ সৈন্য পাঠাতে পারে। ডেভিস বিশ্বাস করেন, আরাকান আর্মির এই বন্দর দখলের "অনেক সম্ভাবনা" রয়েছে।
চীনা একটি শিল্প সূত্রের বরাত দিয়ে ডেভিস জানান, প্রায় ৫০ জন চীনা নিরাপত্তা কর্মী কিয়াউকফিউতে রয়েছেন। তিনি মনে করেন, বেইজিং হয়তো মেনে নিয়েছে যে বন্দরটি আরাকান আর্মির দখলে যেতে পারে, যতক্ষণ তাদের সম্পদ সুরক্ষিত থাকে।
ইউএলএ প্রতিনিধি জানান, কিয়াউকফিউ আরাকান আর্মির জন্য একটি "সংবেদনশীল এলাকা"। তারা সেখানে "যতটা সম্ভব কম শক্তি" ব্যবহার করছে এবং "সকল দেশের বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মীদের সুরক্ষার নীতি" বজায় রাখছে।
বাড়ছে যুদ্ধের পরিধি
রাখাইনে ভারতেরও কালাদান পরিবহন প্রকল্পের মাধ্যমে বড় স্বার্থ জড়িত। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করা। বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দর ও নদী নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ পেলে আরাকান আর্মি ভারতীয় বাণিজ্য থেকে কর আদায় করতে পারবে। এতে তাদের আর্থিক শক্তি বাড়বে এবং নয়াদিল্লির সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক দুর্বল হবে।
যদি আরাকান আর্মি রাখাইনের উপকূলীয় বন্দরগুলো দখল করতে পারে, তবে তারা চীন ও ভারত উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ নিয়ন্ত্রণ করবে। এটি তাদের এমন এক সুবিধা দেবে, যা মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের অন্য কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেই। ডেভিস বলেন, এর ফলে আরাকান আর্মি-সমর্থিত সরকার একটি আঞ্চলিক শক্তি হয়ে উঠতে পারে।
ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি-মিয়ানমার জানায়, আরাকান আর্মি রাখাইনের বাইরেও নিজেদের বিস্তার ঘটিয়েছে এবং এখন দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
সামরিক বাহিনী দেশের অন্যান্য অঞ্চলে হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করছে এবং ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা এরই মধ্যে একটি পাতানো নির্বাচন হিসেবে সমালোচিত। এমন পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মি হয়তো একদিন সামরিক সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে পারে, অথবা একাই সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
ইউএলএ প্রতিনিধি সামরিক বাহিনীর ঐতিহ্যবাহী "বিভক্ত করে শাসন" নীতির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, "যুদ্ধে উত্থান-পতন থাকেই। এবার আমরা আত্মবিশ্বাসী যে প্রতিরোধ শক্তিগুলো দেশে একটি অর্থপূর্ণ পরিবর্তন আনবে।"