২০০ চুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাম্প—বাস্তবে হয়েছে ৩টি, আরেকটি চূড়ান্ত হওয়ার পথে

এপ্রিলের শেষে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম ১০০ দিন পূর্তিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ক আলোচনা-সংক্রান্ত অগ্রগতি নিয়ে এক চমকপ্রদ মন্তব্য করেছিলেন: তিনি ২০০টি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করে ফেলেছেন। অথচ এর দুই মাসেরও বেশি সময় পর ট্রাম্প সেগুলোর মধ্যে মাত্র তিনটি চুক্তির কথা ঘোষণা করেছেন—চীন, যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনামের সঙ্গে।
তাহলে তার ২০০ দেশের সঙ্গে চুক্তির কী হলো?
তিন মাস আগে ট্রাম্প ৯ জুলাইকে সব দেশের জন্য বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছানোর চূড়ান্ত দিন নির্ধারণ করেছিলেন। ব্যর্থ হলে দেশগুলোর ওপর চড়া হারে 'পারস্পরিক শুল্ক' আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন। তবে ট্রাম্প পরে নিজেই স্বীকার করেছেন, ৯ জুলাই পর্যন্ত এই শুল্কারোপ স্থগিত রাখায় কার্যত প্রায় সব দেশের সঙ্গে আলোচনার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রথমে ৯ জুলাইয়ের মধ্যেই আরও বেশি বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আশা করেছিলেন। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে তিনি বুঝতে পারেন, চুক্তিগুলো এরচেয়ে দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এ কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে তার বক্তব্যে পরিবর্তন এসেছে। তিনি এখন বলছেন, আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অংশীদারদের কাছে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের চিঠি পাঠাবেন, যা ফল নিয়ে আসবে।
এ কারণেই ট্রাম্প সময়সীমা পিছিয়ে ১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়াতে সম্মত হয়েছেন। এর ফলে যেসব দেশ চুক্তির কাছাকাছি রয়েছে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), তারা আলোচনার জন্য আরও কিছুটা সময় পাবে। ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
ইইউয়ের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত তিনজন কর্মকর্তা বলেন, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা একটি 'ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট' বা কাঠামো চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছেছেন। এই চুক্তির আওতায় ১০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হবে এবং ভবিষ্যতে ব্যাপক বাণিজ্য আলোচনার জন্য রূপরেখা তৈরি করা হবে।
বিশেষত ইইউয়ের সঙ্গে আলোচনায় এই অগ্রগতি ৯ জুলাইয়ের পর সময়সীমা বাড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ। বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুইজন ব্যক্তি জানান, মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ইইউয়ের সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেন। পাশাপাশি আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে—এই যুক্তিতে তিনি আরও সময়ের পক্ষে কথা বলেন।
যেকোনো চূড়ান্ত চুক্তিতে ট্রাম্পের অনুমোদন এখনও বাকি এবং দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সপ্তাহের শেষ হওয়ার আগেই চুক্তিটি ঘোষণা করা হবে। ইউরোপীয় কমিশনের বাণিজ্যবিষয়ক মুখপাত্র ওলফ গিল বুধবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে নিশ্চিত করেছেন, ইইউয়ের বাণিজ্য আলোচকরা মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক ও মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ারের সঙ্গে সক্রিয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন; আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই চুক্তি ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই অগ্রগতি ইইউয়ের প্রতি ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের প্রকাশ্য বিতৃষ্ণার নাটকীয় পরিবর্তন তুলে ধরে। এই বিতৃষ্ণার কারণেই চলতি বছর কয়েক মাস ধরে বাণিজ্য আলোচনা হতাশাজনক ও জটিল পর্যায়ে ছিল।
মে মাসের শেষের দিকে সকালে এক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে ট্রাম্প অপ্রত্যাশিতভাবে ইইউয়ের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দেন। তবে এরপর থেকে তার কথার সুর এবং পর্দার আড়ালে আলোচনার গতি ও ধরনে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। এই আকস্মিক ও কঠোর হুমকি ইইউকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য করে এবং ট্রাম্পের 'পারস্পরিক শুল্ক' কার্যকর হওয়ার আগেই চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য জরুরি উদ্যোগের পথ তৈরি করে দেয়।
ইইউয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, জোটের কর্মকর্তারা সদস্য দেশগুলোকে এই কাঠামো চুক্তি এবং প্রস্তাবিত আলোচনা প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করছেন। তিনি আরও বলেন, জোটের দেশগুলোর প্রায়শই আলাদা স্বার্থ থাকলেও এ চুক্তিকে ১ আগস্ট নাটকীয়ভাবে শুল্ক বৃদ্ধি এড়ানোর সেরা ও সম্ভাব্য একমাত্র উপায় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, ইতিমধ্যে কার্যকর থাকা বা আসন্ন খাতভিত্তিক শুল্ক ছাড় দেওয়ার বিষয়ে ইইউয়ের দাবির বিষয়ে ট্রাম্পের পক্ষে আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা কঠোর অবস্থান ধরে রেখেছেন। যেমন, গাড়ির ওপর ট্রাম্পের ২৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর বিষয়টি শেষ মুহূর্তের আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। একইভাবে ইস্পাতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কমানোর চেষ্টাও চলছে।
তবে মার্কিন আলোচকরা ইইউয়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্প ও পণ্যের জন্য শুল্ক হার কমানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে কিছুটা নমনীয়তা দেখানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বিমান, অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় ও কিছু কৃষি পণ্য। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর জন্য ট্রাম্পের চূড়ান্ত অনুমোদন লাগবে।
ইইউ কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা খাতের পণ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্রয়ের অঙ্গীকারও করেছেন।
চুক্তি না হলে ইইউতে যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির ওপর পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে জোটটি।
এসব পাল্টা পদক্ষেপ ১৪ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। তবে ট্রাম্পের 'পারস্পরিক' শুল্ক কার্যকরের সময়সীমা ১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলিয়ে ইইউও ওই তারিখ পেছাবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ডেনমার্কের ইউরোপীয় বিষয়াবলির মন্ত্রী মেরি বিয়েরে বুধবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে মনে করিয়ে দেন, ;নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কোনো চুক্তি না হলে ইইউ তার ন্যায্য স্বার্থ রক্ষায় লক্ষ্যভিত্তিক ও আনুপাতিক পাল্টা ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত।' তিনি আরও বলেন, ইইউয়র ধৈর্যেরও সীমা আছে।
অন্যান্য চুক্তি নিয়ে এখনও কাজ চলছে
বাণিজ্য আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়ায় ট্রাম্প হতাশ। মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে তিনি বলেন, তার শুল্ক আরোপের হুমকি বাণিজ্যিক অংশীদারদের আলোচনার টেবিলে আনতে সফল হয়েছে—কিন্তু অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে যেসব চুক্তির প্রস্তাব দিচ্ছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
ট্রাম্প বলেন, 'ওরা বলে... .আমরা আপনাদের সম্পূর্ণ প্রবেশাধিকার দেব, আপনাদের কোনো শুল্ক দিতে হবে না, কিন্তু দয়া করে আমাদের ওপর শুল্ক আরোপ করবেন না"। কিন্তু এ ধরনের চুক্তি আমাদের পছন্দ নয়।'
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, 'আমরা কট্টরপন্থী নই। কিন্তু এখন সময় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেইসব দেশ থেকে টাকা আদায় করার, যারা আমাদের ঠকিয়ে আসছিল—ঠকিয়ে আসছিল—এবং আমরা কতটা বোকা ছিলাম, তা নিয়ে আমাদের পেছনে হাসাহাসি করছিল।'
ট্রাম্প চলতি সপ্তাহে নতুন শুল্ক আরোপ করে বেশ কয়েকটি চিঠি পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের চিঠিও রয়েছে।
অন্যান্য দেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করা আরও কঠিন হচ্ছে।
ভারতকে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাঠামো চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সম্ভাব্য প্রধান অংশীদার হিসেবে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বাণিজ্য আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা তাদের অবস্থান আরও কঠোর করেছেন। ভারত ব্রিকস জোটেরও সদস্য। তাই রোববার ট্রাম্প ব্রিকস দেশগুলোর ওপর ১০ শতাংশ শুল্কের যে হুমকি দিয়েছেন, বাণিজ্য আলোচনায় তার তাৎপর্য কী সেটি এখনও পরিষ্কার নয়।
কয়েক সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। যদিও ট্রাম্পের আরোপিত গাড়ির শুল্ক সেই আলোচনায় অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রয়ে গেছে। এর মধ্যেই সোমবার ট্রাম্পের পাঠানো চিঠি আলোচনাকে হয়তো আরও জটিল করে তুলেছে।
গত কয়েক সপ্তাহে চুক্তির সম্ভাবনা থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেছে জাপান। একসময় যে আলোচনা নিশ্চিত চুক্তির পথে এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল, ট্রাম্প এখন সেই আলোচনা নিয়েই বড় ধরনের সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। জাপানের বাণিজ্য আলোচকরা—যারা কয়েক সপ্তাহ আগেও জি-৭ সম্মেলনের মধ্যে ঘোষণার ভিত্তি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন—তারা গত কয়েক দিন ধরে প্রকাশ্য বিবৃতিতে অনেক বেশি হতাশাজনক বার্তা দিয়েছেন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা মঙ্গলবার বলেছেন, 'আন্তরিক ও অকপট আলোচনা' সত্ত্বেও জাপান কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি। ইশিবা বলেন, 'আমরা গভীরভাবে দুঃখিত যে মার্কিন সরকার অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে এবং শুল্কের হার বাড়ানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।'
অন্যদিকে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড—এই তিনটি দেশই চুক্তির দৌড়ে এগিয়ে থাকতে গত দুই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে যেকোনো চুক্তির ক্ষেত্রে এই দেশগুলো এগিয়ে থাকতে পারে।
মার্কিন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্রাজিলও চুক্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। নির্দিষ্ট কিছু মার্কিন পণ্যে শুল্ক ব্যাপকভাবে কমানোর আগের প্রস্তাবকে আরও সম্প্রসারিত করতে গত সপ্তাহের শেষে তারা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেছে।
বিদেশি বাণিজ্য দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় আপত্তির জায়গা হলো, চূড়ান্ত চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কী ভাবছে, সে বিষয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।
তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, এই ব্যাপক আলোচনাগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে গাড়ি, ইস্পাত ও ওষুধের ওপর ট্রাম্পের আরোপিত বা প্রতিশ্রুত খাতভিত্তিক শুল্ক।