নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পকে মনোয়ন দিলেন নেতানিয়াহু

সোমবার রাতে হোয়াইট হাউসের নৈশভোজে অংশ নিতে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বিশেষ উপহার দেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু—একটি চিঠি, যাতে ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
ট্রাম্পের কাছে এই পুরস্কার এখন আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তার দাবি, বিশ্বজুড়ে সংঘাত নিরসনে বিশেষ করে গাজা যুদ্ধ বন্ধে তার প্রচেষ্টা পুরস্কার পাওয়ার যথেষ্ট যোগ্যতা তৈরি করেছে।
২১ মাস ধরে চলা গাজা যুদ্ধের একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নির্ভর করছে নেতানিয়াহুর সেই চুক্তি গ্রহণের ওপর, যা যুদ্ধ পুরোপুরি থামাবে। হোয়াইট হাউসের ব্লু রুমে অনুষ্ঠিত ওই নৈশভোজে ট্রাম্প এ বিষয়েই নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলোচনা করতে চান।
তবে খাবার পরিবেশনের আগেই নেতানিয়াহু শান্তি প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের ভূমিকার প্রশংসা করেন। চুক্তি এখনো চূড়ান্ত না হলেও তিনি বলেন, "তিনি এখনই একের পর এক দেশ ও অঞ্চলে শান্তি স্থাপন করছেন।" এরপর টেবিলের ওপার থেকে একটি চিঠি ট্রাম্পকে দিয়ে বলেন, "মি. প্রেসিডেন্ট, আমি নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটিকে যে চিঠি পাঠিয়েছি, সেটি আপনার জন্য। এতে আপনাকে শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আপনার এটি প্রাপ্য, এবং আপনার এটি পাওয়া উচিত।"
ট্রাম্প জবাবে বলেন, "ধন্যবাদ। আমি জানতাম না। বাহ!" আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, "আপনার কাছ থেকে এটি পাওয়া সত্যিই বিশেষ কিছু। ধন্যবাদ, বিবি।"
ট্রাম্পের দৃষ্টিতে গাজা যুদ্ধের অবসান শুধু নোবেল জয়ের আরেক ধাপ নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে তার দীর্ঘমেয়াদি শান্তি কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নৈশভোজ শুরুর সময় তিনি বলেন, "আমি যুদ্ধ থামাচ্ছি। আমি যুদ্ধ থামাচ্ছি। এবং আমি ঘৃণা করি মানুষকে মরতে দেখা।"
এই লক্ষ্য অর্জনে নেতানিয়াহুকে ট্রাম্প গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মনে করলেও, নেতানিয়াহু কখনো কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ালে তিনি প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এখন ট্রাম্প চান, হামাস ও নেতানিয়াহু এমন একটি চুক্তিতে সম্মত হোন, যার ভিত্তিতে যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হবে—যা এর আগে উভয়পক্ষ প্রত্যাখ্যান করেছিল।
নেতানিয়াহুর সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে ট্রাম্প একদিকে যেমন তাকে আমন্ত্রণ জানান, ইরানের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধকে সমর্থন দেন, এমনকি দুর্নীতির মামলাও বাতিলের আহ্বান জানান; তেমনি গাজা যুদ্ধ শেষ করতে তার ওপর চাপও তৈরি করছেন।
ট্রাম্প বলেন, "আমরা চমৎকার সময় কাটিয়েছি। অনেক কাজ ছিল, কিন্তু আমরা দারুণ ফল পেয়েছি।" তিনি ইঙ্গিত দেন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সাম্প্রতিক বিমান হামলার দিকে এবং বলেন, "আমরা আরও অনেক ভালো ফল পাব।"
দীর্ঘ সময় স্থবির থাকার পর গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে একটি চুক্তির পথে গতি ফিরে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হোয়াইট হাউসে নেতানিয়াহুর সফরের সময় ট্রাম্পের চাপ যেন আলোচনার পথ রুদ্ধ না করে, সেটিই এখন মূল লক্ষ্য।
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইকেল ওরেন বলেন, "প্রেসিডেন্ট চাইলে প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ দিতে পারেন, আবার প্রলোভনও দেখাতে পারেন—যেমন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বিকল্প রাখবে—যদিও আমেরিকান জনগণের মধ্যে ইরানে সামরিক হস্তক্ষেপ নিয়ে বিরোধিতা রয়েছে।"
ইসরায়েল ও হামাসের আলোচকরা কাতারে বসে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির খসড়া চুক্তি নিয়ে কাজ করছিলেন। এতে পর্যায়ক্রমে জিম্মি মুক্তি ও গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবাহের সুযোগ রাখা হয়েছে। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, ট্রাম্পের পররাষ্ট্র দূত স্টিভ উইটকফ এই সপ্তাহেই আলোচনায় যোগ দেবেন—যা অগ্রগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গত সপ্তাহের শুরুতে কাতার এই প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং ইসরায়েল দ্রুত তা গ্রহণ করে। এতে হামাসের একটি প্রধান দাবি রাখা হয়—যাতে যুদ্ধবিরতির এই চুক্তি ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাবে।
শুক্রবার হামাস জানায়, তারা প্রস্তাবটির প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে, তবে কিছু সংশোধন চেয়েছে। যদিও ইসরায়েল সেগুলোকে "অগ্রহণযোগ্য" বলে মন্তব্য করে, তবু তারা একটি প্রতিনিধি দল পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে, যা চূড়ান্ত চুক্তির আগের শেষ ধাপ।
চলমান আলোচনা প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, "তারা (হামাস ও ইসরায়েল) একসঙ্গে বসতে চায় এবং যুদ্ধবিরতি চায়।"
এর আগেও যুদ্ধবিরতির প্রায় চূড়ান্ত চুক্তি ভেস্তে গিয়েছিল। তবে ইসরায়েল-ইরানের ১২ দিনের যুদ্ধ পরবর্তী আঞ্চলিক বাস্তবতা এই আশার জন্ম দিয়েছে যে, এবার হয়তো চুক্তি হবে।
মাইকেল ওরেন বলেন, "প্রধানমন্ত্রী এই বৈঠকে আসছেন ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের বিজয় নিয়ে, প্রেসিডেন্ট আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেই একই বিজয় নিয়ে। উভয় নেতাই কিছুটা নমনীয়তা দেখাতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট যে এই চুক্তি চান, তা স্পষ্ট।"
যদি কোনো চুক্তি হয়, ট্রাম্প তার কৃতিত্ব নিতে প্রস্তুত—নেতানিয়াহুর সহযোগিতায়। সফর শুরুর আগে নেতানিয়াহু বলেন, তার এই ওয়াশিংটন সফর "ফলাফল এগিয়ে নিতে অবশ্যই সহায়ক হবে।" ট্রাম্পও আশাবাদী ছিলেন, এই বৈঠকই অগ্রগতির পথে বড় ধাপ হতে পারে।
রোববার নিউ জার্সিতে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, "আমার মনে হয়, আমরা আগামী সপ্তাহেই হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে পারি, যাতে অনেক জিম্মির বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।"
ট্রাম্পের দৃষ্টিতে গাজা যুদ্ধের অবসান শুধু যুদ্ধবিরতির বিষয় নয়—এটি তার বৃহত্তর আঞ্চলিক লক্ষ্য পূরণের একটি ধাপ, যার মূল পুরস্কার হলো সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ। এটি হবে আব্রাহাম চুক্তির অংশ, যা ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে মধ্যস্থতা করেছিলেন। সৌদি আরব এই চুক্তিতে যোগ দিলে আরও কিছু আরব বা মুসলিম দেশও এতে অংশ নিতে পারে।
তবে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান স্পষ্ট করেছেন, গাজা যুদ্ধ চলাকালে এমন কোনো স্বাভাবিকীকরণ সম্ভব নয়। ফলে যুদ্ধবিরতির একটি চুক্তি ট্রাম্পের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সোমবার নেতানিয়াহু বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, আঞ্চলিকভাবে আরও বিস্তৃত শান্তি অর্জন সম্ভব। তিনি বলেন, "আমার বিশ্বাস, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে এবং একসঙ্গে কাজের মাধ্যমে আমরা আমাদের ও পুরো মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে একটি খুব বিস্তৃত শান্তিচুক্তি অর্জন করতে পারি, যা আমাদের সব প্রতিবেশীকেই অন্তর্ভুক্ত করবে।"
ট্রাম্পের বৃহৎ পরিকল্পনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার ভবিষ্যৎ। ইসরায়েল জোর দিয়ে বলছে, হামাস আর শাসক থাকতে পারবে না। তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কী ভূমিকা নেবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। অথচ গাজা পুনর্গঠনে উপসাগরীয় দেশগুলোর সহায়তা নিশ্চিত করতে এই কর্তৃপক্ষের ভূমিকাই হতে পারে মূল।
কম আলোচিত একটি বিষয় হলো ট্রাম্পের একটি প্রস্তাব—যা তিনি ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে নেতানিয়াহুর সফরের সময় দিয়েছিলেন—গাজার নিয়ন্ত্রণ দখল, ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের সরিয়ে দেওয়া এবং অঞ্চলটিকে "মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা" হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলেন তিনি।
হোয়াইট হাউসের ইস্ট রুমে সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে এ প্রস্তাব তুলে ধরেন ট্রাম্প, যা তখন ব্যাপক আলোড়ন তোলে। তবে সাম্প্রতিক আলোচনায় এটি অনেকটাই পেছনের সারিতে চলে গেছে।
সোমবার ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়, তার "পুনর্বাসন পরিকল্পনা" এখনো আলোচনার টেবিলে আছে কি না। জবাবে তিনি বলেন, এটি নেতানিয়াহুর কাছে জিজ্ঞেস করাই ভালো।
নেতানিয়াহু বলেন, "আমি মনে করি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অসাধারণ। এটিকে বলা যায় 'ফ্রি চয়েস'। আপনি জানেন, যদি কেউ থাকতে চায়, তারা থাকতে পারে, আর যদি কেউ চলে যেতে চায়, তাহলে তাদের যাওয়ার সুযোগ থাকা উচিত। এটা যেন কোনো কারাগার না হয়।"