রাশিয়ার হয়ে লড়তে আরও ৩০ হাজার সেনা পাঠাচ্ছে উত্তর কোরিয়া, দাবি ইউক্রেনের

ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত জোট আরও দৃঢ় করতে উত্তর কোরিয়া আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অতিরিক্ত ২৫ থেকে ৩০ হাজার সেনা রাশিয়ায় পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়েছে।
ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়নে বলা হয়েছে, এর আগেও গত বছরের নভেম্বর মাসে গোপনে উত্তর কোরিয়া প্রায় ১১ হাজার সেনা পাঠিয়েছিল, যারা রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর হামলা প্রতিহত করতে ভূমিকা রাখে। পশ্চিমা কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ের অভিযানে প্রায় ৪ হাজার উত্তর কোরীয় সেনা আহত বা নিহত হয়। তবু এরপর থেকেই পিয়ংইয়ং ও মস্কোর সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
গোয়েন্দা মূল্যায়নে আরও বলা হয়, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় উত্তর কোরিয়ার সেনাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারে, ফলে তারা রুশ বাহিনীর সঙ্গে একযোগে ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চলে বড় আকারের অভিযানে অংশ নিতে পারে।
সিএনএনের হাতে আসা স্যাটেলাইট ছবি এবং ইউক্রেনীয় গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উত্তর কোরিয়ার সেনাদের পরিবহনের জন্য রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলজুড়ে বিমান ও জাহাজ প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। উল্লেখ্য, রাশিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে সীমান্ত রয়েছে।
এছাড়া, উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ের সুনান বিমানবন্দরে গত মাসে যে কার্গো বিমানগুলোকে দেখা গেছে, সেগুলো সম্ভবত আইএল-৭৬ ধরনের, গত বছরও সেনা পরিবহনে এসব বিমান ব্যবহৃত হয়েছিল। একইসঙ্গে রাশিয়ার দুনাই বন্দরে রোপুচা শ্রেণির ট্রুপ ক্যারিয়ার জাহাজের গতিবিধি দেখা গেছে, যা প্রায় ৪০০ সেনা পরিবহনে সক্ষম।
ওপেন সোর্স সেন্টারের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক জো বার্ন বলেন, "স্যাটেলাইট চিত্রে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, মে মাসে দুনাই বন্দরে সেনাবাহী নৌযান এসেছে, এবং মে-জুনে সুনান বিমানবন্দরে ব্যাপক তৎপরতা চলছে। এটি ইঙ্গিত দেয়, আগের যে রুটে উত্তর কোরিয়ান সেনাদের আনা হয়েছিল, সেটি আবার সক্রিয় হয়েছে।"
উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে সরাসরি সেনা পাঠানোর প্রেক্ষাপট
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন ইতিমধ্যেই (ইউক্রেন যুদ্ধে) প্রকাশ্যে রাশিয়ার পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্টিমসন সেন্টারের কোরিয়া কর্মসূচির পরিচালক জেনি টাউন বলেন, "৩০ হাজার সেনা সংখ্যা হয়তো একটু বেশি মনে হতে পারে, তবে উত্তর কোরিয়া এ পরিমান সেনা পাঠাতে সক্ষম। যদিও তারা অভিজাত বা প্রশিক্ষিত সেনা হবে না।"
তিনি আরও বলেন, "সম্ভবত ধাপে ধাপে ১০ থেকে ২০ হাজার সেনা পাঠানোই বেশি বাস্তবসম্মত। শোনা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে রুশ জেনারেলরা উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে সেনাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।"
এদিকে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুস্তম উমেরভ বলেন, "রাশিয়ার ওপর উত্তর কোরিয়ার অভিজাত সেনাদের নির্ভরতা স্পষ্ট করছে যে, ক্রেমলিনের নিজস্ব রিজার্ভ ফোর্সে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।"
তিনি সতর্ক করেন, এত বড় সংখ্যায় সেনা পাঠিয়ে কিম জং উন নিজ দেশের সামরিক সক্ষমতা দুর্বল করার ঝুঁকি নিচ্ছেন।
ইউক্রেনের সেনাপ্রধান ওলেক্সান্ডার সিরস্কি জানান, রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর পোকরভস্কের কাছে ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করছে, যা বড় আকারের হামলার পূর্বাভাস হতে পারে।
উত্তর কোরিয়া-রাশিয়ার গভীর সামরিক সহযোগিতা
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু গত ১৭ জুন দ্বিতীয়বারের মতো উত্তর কোরিয়া সফর করেন। সেখানে তিনি জানান, উত্তর কোরিয়ার ১ হাজার মাইন অপসারণ বিশেষজ্ঞ এবং ৫ হাজার সামরিক নির্মাণকর্মী রাশিয়ায় পাঠানো হবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনআইএস) জানিয়েছে, জুলাই বা আগস্টের মধ্যেই এই সেনা প্রেরণ শুরু হতে পারে।
রুশ সংবাদমাধ্যম ও টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোতে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, উত্তর কোরিয়ান সেনারা কুরস্ক অঞ্চলের পোস্টোয়ালিয়ে দভরি গ্রামের কাছে পরিখায় অবস্থান করছে। সেখানে তাদের খাবার ও অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীসহ ব্যারাকে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যারাকের দেয়ালে কোরিয়ান ভাষায় লেখা "আমাদের শহীদদের প্রতিশোধ নিতে হবে।"
রুশ সেনাদের প্রশিক্ষকেরা জানান, ২৩ থেকে ২৭ বছর বয়সী উত্তর কোরিয়ান সেনারা শারীরিকভাবে বেশ প্রস্তুত এবং সাহসিকতায় রুশ সেনাদের থেকেও পিছিয়ে নেই।
এছাড়া, রুশ রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাসের প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর কোরিয়ান সেনারা এখন রুশ সেনাদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ভবন পরিষ্কার, ক্লোজ কমব্যাট যুদ্ধ প্রশিক্ষণ এবং ইউক্রেনীয় ড্রোন ভূপাতিত করতে শটগান ব্যবহারের মতো প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তথ্য ফাঁস
সিএনএনের এক মাসব্যাপী তদন্তে আরও উঠে এসেছে, উত্তর কোরিয়ার তৈরি কেএন-২৩ এবং কেএন-২৪ ব্যালিস্টিক মিসাইল ইউক্রেনে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জানুয়ারি ২০২৪ সালে পোকরভস্ক শহরে এমন এক হামলায় ১১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে এসব ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার আরও বেড়েছে।
ভূরাজনৈতিক উদ্বেগ
পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, উত্তর কোরিয়ার এই পদক্ষেপ শুধু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধেই নয়—পুরো বিশ্ব নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে। বিশেষ করে রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও ইরানসহ একাধিক কর্তৃত্ববাদী সরকারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।