ইরানের মোসাদ-আতঙ্ক বাড়ছে, সন্দেহ এখন ‘মাস্ক, টুপি ও সানগ্লাসে’

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের অনুপ্রবেশ নিয়ে আতঙ্ক চরমে পৌঁছেছে ইরানে। সম্প্রতি গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে রাজধানী তেহরানসহ দেশজুড়ে বহু মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে ইরান কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানে হামলার আগেভাগেই অস্ত্র পাচার করে এবং সেই অস্ত্র দেশটির অভ্যন্তর থেকেই হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে।এ তথ্য বের হবার পরে দেশটিতে গ্রেপ্তার বেড়েছে।
শুক্রবার ইসরায়েলের হামলার পর থেকে তেহরানে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সোমবার, দুই বছর আগে একই অভিযোগে গ্রেপ্তার এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। এটি যেন সম্ভাব্য এক সতর্কবার্তা গুপ্তচরদের প্রতি।
এছাড়াও, 'অনলাইনে ইসরায়েলপন্থী কনটেন্ট শেয়ার' করার অভিযোগে ইরানজুড়ে আরও বহু মানুষকে আটক করা হয়েছে। ইরান প্রশাসনের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব কর্মকাণ্ড 'সমাজের মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তা নষ্ট করছে।' শুধু ইসফাহানেই ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইসরায়েল দাবি , এখানে একটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে ।
তেহরানের পাবলিক প্রসিকিউটরের দপ্তরে একটি বিশেষ ইউনিট গঠন করা হয়েছে, যারা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের উপর নজরদারি করছে।
জনসাধারণকে এখন বলা হচ্ছে, সন্দেহজনক কোনো কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে। কীভাবে গুপ্তচর বা সহযোগী চিনতে হয়, সে বিষয়ে ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় জনগণকে নির্দেশিকাও দিচ্ছে।
দেশটির গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে জনগণকে বলা হচ্ছে, মাস্ক বা চশমা পরা অপরিচিত কেউ পিকআপ গাড়ি চালিয়ে ঘোরাঘুরি করলে, বড় ব্যাগ বহন করলে বা সেনা, আবাসিক কিংবা শিল্প এলাকায় ভিডিও করলে সঙ্গে সঙ্গে তা পুলিশের কাছে জানানোর জন্য।
রাষ্ট্রঘনিষ্ঠ নূর নিউজ একটি পোস্টার প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে , "মাস্ক, টুপি ও সানগ্লাস পরা মানুষ, বিশেষ করে রাতেও যারা এগুলো পরে থাকে, তারা সন্দেহভাজন।" তারা আরও জানায়, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঘন ঘন প্যাকেট ডেলিভারি পাওয়াদের উপরও নজরদারি রাখা দরকার।
অন্য একটি পোস্টারে লেখা হয়েছে, "বাড়ির ভেতর থেকে অস্বাভাবিক শব্দ, যেমন চিৎকার, ধাতব যন্ত্রপাতির শব্দ বা বারবার ধাক্কাধাক্কির শব্দ শোনা গেলে, কিংবা এমন বাড়ি যেগুলোর পর্দা সারা দিন টানা দেওয়া থাকে" এসবকিছু এখন সন্দেহের আওতায়।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশের একটি পোস্টারেও বাড়িওয়ালাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, যারা সম্প্রতি বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন, তারা যেন সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এদিকে সিএনএন-কে ইরানি কয়েকজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, এখন রাস্তায় ছবি তোলারও অনুমতি নেই। সাংবাদিকদের ওপরও চলছে কড়া নজরদারি।
ইসরায়েলি অনুপ্রবেশের এই ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ইরানের নেতৃত্বের মধ্যে চলমান অস্থিতিশীলতা। বিগত বছরগুলোতে 'মোরালিটি পুলিশ'-এর হেফাজতে এক তরুণীর মৃত্যুর পর থেকে দেশজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে শাসকগোষ্ঠী।

সেই সময়কার ইরানের বিপ্লবী গার্ডের সহযোগী বাহিনী বাসিজ আবার সক্রিয় হয়েছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, তাদের এখন রাতের পাহারায় নামানো হয়েছে নজরদারি বাড়ানোর জন্য।
সোমবার এক ভিডিও বিবৃতিতে ইরানের পুলিশ প্রধান আহমাদ-রেজা রাদান সম্ভাব্য 'বিশ্বাসঘাতকদের' আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যারা বুঝতে পেরেছে যে তারা শত্রুদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে, তারা আত্মসমর্পণ করলে নমনীয় আচরণ পাবে এবং 'সম্মানিত' হবে। তবে যারা ধরা পড়বে, তাদের এমন শিক্ষা দেওয়া হবে যা এখন জায়নবাদী শত্রুরা পাচ্ছে।
ইরানের প্রধান বিচারপতি গোলাম-হোসেইন মোহসেনি-এজেই বলেছেন, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কাজ করেছে, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তার ভাষায়, "যুদ্ধ পরিস্থিতির মতো এই সময়ে যারা ধরা পড়েছে, তাদের বিচার দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক হওয়া উচিত।"
এই আতঙ্ক তখনই চরমে ওঠে, যখন আরও বিস্তারিত প্রকাশ্যে আসে মোসাদের গোপন অভিযান। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দাবি, মোসাদ ইরানের ভেতরেই ড্রোন হামলার জন্য একটি ঘাঁটি তৈরি করে এবং সেখান থেকে বিস্ফোরক ড্রোন চালানো হয় তেহরানের কাছে মিসাইল লঞ্চারের দিকে।
তাদের দাবি অনুযায়ী, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলার জন্য অত্যাধুনিক অস্ত্রও পাচার করা হয়েছিল, যেগুলোর সাহায্যে বিমানবাহিনীর জন্য আকাশপথ পরিষ্কার করা হয়। এরপর শুক্রবার ভোররাতে ২০০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান দিয়ে ১০০টিরও বেশি হামলা চালায় ইসরায়েল।
মোসাদ যে তথ্য সংগ্রহ করেছে, তার ভিত্তিতে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তু করতেও সক্ষম হয়েছে বলে দাবি করে ইসরায়েল।
ইরানি সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, এই অভিযানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, ড্রোন, বিস্ফোরকসহ নানা সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে তেহরান প্রদেশের রেই শহর থেকে। উদ্ধারকৃত দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ২০০ কেজি বিস্ফোরক, আত্মঘাতী ড্রোন, লঞ্চার ও ড্রোন তৈরির সরঞ্জাম।
রাষ্ট্রঘনিষ্ঠ ফার্স নিউজ একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে একটি ভবনের ভেতরে ড্রোনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য সামগ্রী দেখা যায়।
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা