সবকিছু মনে রাখা সম্ভব নয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখার ৫ উপায়

ভুলে যাওয়ার বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার সঙ্গে কমবেশি আমরা সকলে পরিচিত। সেটা হতে পারে মুখে এসে আটকে যাওয়া কোনো শব্দ, চাবি বা চশমার মতো দরকারি জিনিস কোথাও রেখে ভুলে যাওয়া, কিংবা কোনো ঘরে ঢুকে হঠাৎ মনে না থাকা 'কেন এসেছিলাম?'
প্রতিটি মুহূর্তে আমরা স্মার্টফোন, টেলিভিশন, কম্পিউটার ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যম থেকে অবিরত তথ্যের মুখোমুখি হচ্ছি। এতো তথ্যের ভারে ভুলে না যাওয়াই যেন কঠিন।
গড়পড়তা একজন আমেরিকান প্রতিদিন গড়ে ৩৪ গিগাবাইট অথবা ১১.৮ ঘণ্টার সমপরিমাণ তথ্যের মুখোমুখি হন, লিখেছেন ড. চরণ রঙ্গনাথ তার সাম্প্রতিক বই "হোয়াই উই রিমেম্বার - আনলকিং মেমরিস পাওয়ার টু হোল্ড অন টু হোয়াট ম্যাটারস"-এ। এই হিসাব এসেছে ২০০৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ইনফরমেশন ইন্ডাস্ট্রি সেন্টারের এক প্রতিবেদনে।
তার মতে এই বিপুল তথ্য মনে রাখার তো প্রশ্নই আসে না। বরং তিনি বলেন, স্মৃতির বিজ্ঞানে দেখা যায়, মানুষ ভুলে যাওয়ার জন্যই তৈরি।
রঙ্গনাথ তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন ১৯৫৬ সালে মনোবিজ্ঞানী জর্জ মিলারের একটি গবেষণা, যেখানে বলা হয়েছিল, আমরা একসঙ্গে কেবল সাতটি বিষয় মনে রাখতে পারি। পরে আরও গবেষণায় দেখা গেছে, আসল সংখ্যা তিন বা চারটির কাছাকাছি।
"একটা সাধারণ ভুল ধারণা হলো আমরা যা কিছু দেখি বা শুনি, সব কিছুই মনে রাখতে পারব," বলেন তিনি। "আসলে, আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করে একধরনের অর্থনৈতিক নীতিতে, যত কম তথ্য, ততই ভালো, এবং সেই কম তথ্য থেকেই যতটা সম্ভব অর্থ তৈরি করা যায়।"
"সবটাই একধরনের বাছাই প্রক্রিয়া, যেখানে মনোযোগ কাজ করে বড় এক ছাঁকনির মতো, যেটা দিয়ে আমরা ঠিক করি কোন জিনিসগুলো আসলেই গুরুত্বপূর্ণ," বলেন রঙ্গনাথ। "কখনো এটা প্রত্যাশিত , কখনো আবার এমন কিছু মনে থাকে যা হয়তো আমরা আশাই করিনি।"
স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর মানে মাথায় অনেক অনেক তথ্য ভরাট করা নয়। "আমি যেটা বলতে পছন্দ করি, সেটা হলো বেশি বেশি মনে রাখার চেষ্টা কোরো না, বরং ভালোভাবে মনে রাখো" বলেন রঙ্গনাথ। "অনেক সময় ভালোভাবে মনে রাখার মানে হলো কম মুখস্থ করা।
ভুলে যাওয়ার প্রবণতা কমাতে আর কী কী করা যায়? রঙ্গনাথ দিয়েছেন ৫টি কৌশল, যার নাম 'M-E-D-I-C বা 'এম-ই-ডি-আই-সি'।
এম মানে 'অর্থ' (মিনিং)
যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে, সেটিকে এমন কিছুর সঙ্গে যুক্ত করে ভাবতে হবে নিজের কাছে যার গুরুত্ব আছে।
ড. চরণ রঙ্গনাথ বলেন, "যেমন আপনি কারও নাম সহজে মনে রাখতে পারেন, যদি সেটা এমন কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত করে চিন্তা করেন যেটার আপনার কাছে অর্থ আছে।"
উদাহরণ হিসেবে, কেউ যদি গ্রিক পুরাণের ভক্ত হন, তাহলে লেখকের 'চরণ' নামটি গ্রিক পুরাণে বর্ণিত মৃতদের নদী পারাপার করা মাঝি 'চ্যারন'-এর সঙ্গে যুক্ত করে মনে রাখা যেতে পারে।
রঙ্গনাথ বলেন, "আপনি কল্পনা করতে পারেন, আমি মৃতদের নদী পার করে নিয়ে যাচ্ছি।" এভাবে শক্তিশালী ও জীবন্ত কল্পনা একটি নাম দীর্ঘসময় মনে রাখতে সাহায্য করতে পারে।
ই মানে 'ভুল' (ইরোর)
নিজেকে বারবার পরীক্ষার মধ্যে ফেলে ভুল থেকে শেখা স্মৃতি তৈরির একটি কার্যকর উপায়। "আপনি যদি নতুন কোনো নাম বা বিদেশি ভাষার শব্দ শিখতে চান, তাহলে অনুমান করুন সেটা কী হতে পারে বা শব্দটার অর্থ কী হতে পারে," বলেন রঙ্গনাথ।
যখন সঠিক উত্তর শেখা হয়, তখন মস্তিষ্ক সেই স্মৃতিকে এভাবে সংশোধন করে যাতে তা সঠিক উত্তরের সঙ্গে আরও ভালোভাবে যুক্ত হয় এবং ভুল উত্তরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
ডি মানে 'বিশেষত্ব' (ডিসটিংক্টিভনেস)
যেকোনো স্মৃতিকে আলাদা করে তোলা মনে রাখার সম্ভাবনা বাড়ায়। "একগাদা হলুদ খামের মাঝে একটি গাঢ় গোলাপি খাম যেমন খুঁজে পাওয়া সহজ, তেমনি এমন স্মৃতি মনে রাখা সহজ যেগুলোর মধ্যে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে," বলেন রঙ্গনাথ।
উদাহরণস্বরূপ, "আপনি যখন চাবি রাখছেন, তখন একটু সময় নিয়ে সে জায়গার আশপাশের কোনো শব্দ বা চোখে পড়ার মতো কোনো দিক খেয়াল করুন," বলেন তিনি।
এই ছোট্ট মনোযোগের মুহূর্তই পরে মনে রাখতে সাহায্য করবে চাবিটা ঠিক কোথায় রাখা হয়েছিল, বিশেষ করে দ্রুত বাইরে যাওয়ার সময় ।
আই মানে 'গুরুত্ব'(ইম্পর্ট্যান্স)
মস্তিষ্ক এমন অভিজ্ঞতাকে আলাদা করে মনে রাখে যেগুলো জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। "যখন আমরা কোনো আনন্দদায়ক, ভয়ের বা বিব্রতকর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাই, তখন ডোপামিন, নরএড্রেনালিন বা সেরোটোনিনের মতো হরমোন নিঃসৃত হয়, যা মস্তিষ্কের নমনীয়তা বাড়ায়।" বলেন রঙ্গনাথ।
এই রাসায়নিক পদার্থগুলো স্মৃতিকে আরও দৃঢ়ভাবে গেঁথে দিতে সাহায্য করে। "আমরা দেখেছি, কোন বিষয় নিয়ে 'কৌতূহল' স্মৃতি তৈরিতে একই ধরনের প্রভাব ফেলে," বলেন তিনি। "তাই শেখার আগে বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ তৈরি করুন!"
সি মানে 'প্রেক্ষাপট' (কনটেক্সট)
"আমাদের যেসব স্মৃতি নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, যাকে এপিসোডিক মেমোরি বলা হয়, সেগুলো মূলত নির্ভর করে ঘটনাটি কোথায় এবং কখন ঘটেছে তার ওপর" বলেন রঙ্গনাথ।
তাই কলেজ জীবনের গ্রীষ্মকালীন বিদেশ সফরে শোনা কোনো গান, কিংবা দাদির রান্নার গন্ধ হঠাৎ করেই অতীতের কোনো মুহূর্তে মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, "যদি কোনো পুরনো ঘটনা মনে করতে চান, তাহলে নিজেকে সেই সময় ও জায়গায় কল্পনা করুন ।কেমন অনুভব করেছিলে্ন, কী ভাবছিলেন, আশপাশে কী দেখেছিলে্ন আর কী শুনেছিলেন — দেখবে্ন অনেক কিছুই মনে পড়ে যাচ্ছে।"
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা