হার্ডওয়্যারের দোকানে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের গুজবে যেভাবে উত্তাল হলো লস অ্যাঞ্জেলেস

লস অ্যাঞ্জেলেসের কাছে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানের পার্কিং লটে জুয়ান ও তার কয়েকজন বন্ধু জড়ো হন। সেখানে সেই মুহূর্তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন দমননীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। খবর বিবিসির।
সাধারণত সেখানে প্রায় সময়ই ডজন খানেক দিনমজুর অপেক্ষা করেন। তাদের অনেকেই অনিবন্ধিত অভিবাসী। তারা দোকানের ক্রেতা কিংবা ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাজ পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করেন।
কিন্তু রোববার, সেই হোম ডিপো স্টোরের বাইরে মাত্র দুটি ছোট পিকআপ ভ্যান দেখা যায়, যেগুলোতে ছাদ মেরামত, মেরামতির অন্যান্য কাজ কিংবা রঙ করার মতো সেবা দেওয়ার বিজ্ঞাপন ছিল। স্টোরটি প্যারামাউন্ট শহরতলিতে অবস্থিত, যেখানে জনসংখ্যার ৮২ শতাংশের বেশি হিস্পানিক।
স্টোরটিতে অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হওয়ার একদিন পরের ঘটনা এটি। বিক্ষোভের সূত্রপাত হয় একটি গুজব থেকে। সেখানে বলা হয়েছিল, সেখানকার দিনমজুরদের আটক করা হয়েছে।
স্থানীয় অনেক বাসিন্দা বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারা ওই এলাকায় অভিবাসন কর্মকর্তাদের গাড়ি চলাচল করতে দেখেছেন।
এই গুজব তৎক্ষণাৎ ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। এরপর খবর ছড়ায়, হোম ডিপোতে অভিযান চালিয়ে দিনমজুরদের আটক করা হয়েছে।
এই খবরে শহরটিতে বিক্ষোভ শুরু হয়, যা পরবর্তিতে সহিংসতায় রূপ নেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কর্তৃপক্ষ কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও ধোঁয়ার বোমা ব্যবহার করে।
তবে প্যারামাউন্টে এই বিক্ষোভ আসলে ভুয়া তথ্য বা গুজব থেকেই শুরু হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
যদিও ওই এলাকার অন্যান্য স্থানে ডজন খানেক অভিবাসীকে আটক করেছে কর্তৃপক্ষ, কিন্তু হোম ডিপোতে অভিযান চালানো হয়েছে বলে যে গুজব ছড়িয়েছে, তা ছিল ভুয়া—এমনটাই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ (ডিএইচএস)।
ডিএইচএস বিবিসিকে জানায়, 'লস অ্যাঞ্জেলেসের কোনো হোম ডিপোতে আইসিইর কোনো "অভিযান" চালানো হয়নি।'
একটি ছোট টয়োটা পিকআপ ভ্যানের পাশে তার দুই বন্ধুর সঙ্গে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে জুয়ান। তিনি বলেন, 'আসলে কী ঘটেছে, কেউই ঠিক জানে না। সবাই আতঙ্কে আছে।'
প্যারামাউন্টে এই অস্থিরতা আরও বেড়ে যায় একটি গাড়িতে আগুন এবং কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাটের ঘটনার পর। এই ঘটনাগুলো লস অ্যাঞ্জেলেসজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভের একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করে, যাকে ফেডারেল কর্তৃপক্ষ 'দাঙ্গা' হিসেবে বর্ণনা করেছে।
শনিবার, শহরে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করেন—যা সাধারণত কোনো অঙ্গরাজ্যের গভর্নর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
এদিকে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের গভর্নরের অনুমতি ছাড়া ট্রাম্প নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করায় তার বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন অঙ্গরাজ্যটির গভর্নর গ্যাভিন নিউজম।
গতকাল রোববার, তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ যখন আরও তীব্র হয়ে ওঠে, তখন সশস্ত্র ন্যাশনাল গার্ড সদস্যরা হার্ডওয়্যার স্টোরের বিপরীত পাশে একটি গেট দেওয়া বিজনেস পার্ক পাহারা দিচ্ছিলেন।
তারা হামভি গাড়ি এনে এলাকাটি অবরুদ্ধ করে রাখে এবং বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি হন। এসময় বিক্ষোভকারীরা গালিগালাজ করছিল ও মেক্সিকোর পতাকা ও ব্যানার উঁচিয়ে ধরেছিল।
লস অ্যাঞ্জেলেস দলের একটি বল ক্যাপ পরা এক ব্যক্তি সেনাদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন, 'তোমাদের এখানে কেউ চায় না!' এ সময় আরেকজন বিক্ষোভকারী স্প্রে পেইন্টের ঢাকনা খুলে ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইসিই) বিরুদ্ধে অশ্লীল শব্দ দেয়ালে লিখে দেয়।
ডিএইচএস (ডিএইচএস) বিবিসিকে জানিয়েছে, যে এলাকাটি পাহারা দেওয়া হচ্ছিল সেখানে তাদের একটি অফিস রয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ এটিকে 'অপারেশনের প্রস্তুতিস্থল' হিসেবে ব্যবহার করছিল—যা পরে দাঙ্গাকারীদের নজরে পড়ে যায়।
এজেন্সিটি আরও জানায়, ওই সপ্তাহে তারা লস অ্যাঞ্জেলেস এলাকায় ১১৮ জন অনিবন্ধিত অভিবাসীকে আটক করেছে, যাদের মধ্যে পাঁচজনকে তারা গ্যাং সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, আটককৃতদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে অতীতে মাদক পাচার, হামলা এবং ডাকাতির মতো অপরাধের ইতিহাস রয়েছে।
রোববার নিউ জার্সির মরিসটাউনে এয়ার ফোর্স ওনে ওঠার প্রস্তুতিকালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, লস অ্যাঞ্জেলেসে 'সহিংস লোক' রয়েছে এবং 'তারা এভাবে পার পেয়ে যাবে না'।
একই সময়ে, স্থানীয় বাসিন্দা ডোরা সানচেজ আগের রাতের ভয়াবহ চিত্র দেখে এখনো স্তব্ধ হয়ে ছিলেন।
গতকাল তিনি শহরের অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগ দেন চ্যাপেল অব চেইঞ্জ গির্জায়—যেটি আগের দিনের বিক্ষোভের কেন্দ্রস্থল থেকে এক ব্লকেরও কম দূরত্বে অবস্থিত।
গির্জায় ডোরা সানচেজ এবং অন্যরা আলোচনা করেন, কীভাবে তাদের হিস্পানিক সম্প্রদায়টি বছরের পর বছর ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত সমাজে পরিণত হয়েছে—যেখানে প্রতিবেশীরা একে অন্যকে চেনেন এবং খেয়াল রাখেন।
তিনি বলেন, এই বিক্ষোভগুলো অভিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য যেন একটি 'ধৈর্যের সীমা অতিক্রম' ছিল।
লস অ্যাঞ্জেলেস যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু মানুষের শহরগুলোর একটি।
লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে শুধু হিস্পানিকরাই সংখ্যায় বেশি না অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠী, অভিবাসী বিশেষ করে যারা মেক্সিকো থেকে এসেছে তারাও এখানকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই শহর একটি 'সাঙ্কচুয়ারি সিটি' হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ, এটি ফেডারেল ইমিগ্রেশন এনফোর্সমেন্টকে সহযোগিতা করে না।
এখানকার কিছু বাসিন্দা জানান, অভ্যন্তরীণ এক চাপ দীর্ঘদিন ধরে জমে ছিল, যা হঠাৎ বিস্ফোরিত হয় যখন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের প্রশাসন লস অ্যাঞ্জেলেসের অনিবন্ধিত অভিবাসীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।
প্যারামাউন্টে বিক্ষোভকারী মারিয়া গুটিয়েরেজ বললেন, 'এখন উঠে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। এরা আমাদেরই মানুষ।'
তিনি জানান, তিনি মেক্সিকোতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তবে ছোটবেলা থেকে এখানে বসবাস করছেন।
তিনি এবং এখানকার অনেকেই বলেন, তাদের পরিবারের কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রে অনিয়মিতভাবে বসবাস করছেন।
তিনি বলেন, 'এটা হল লস অ্যাঞ্জেলেস। এটা আমাদের সবাইকে স্পর্শ করে।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রত্যেকেরই এমন কেউ পরিবারে বা পরিচিত আছেন যাদের কাছে বৈধ কাগজপত্র নেই।'
ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করায় ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা করবেন নিউজম
এদিকে ট্রাম্প তার নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করায় ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউজম বলেছেন, তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। কারণ ট্রাম্প তার অনুমতি ছাড়াই লস অ্যাঞ্জেলেসে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করেছেন।
নিউজম এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, ট্রাম্প ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। তিনি পরিস্থিতিকে আরও উসকে দিয়েছেন এবং অবৈধভাবে ন্যাশনাল গার্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, 'ট্রাম্প যে আদেশে সই করেছেন, তা শুধু ক্যালিফোর্নিয়ার জন্য নয়। এখন তিনি যেকোনো রাজ্যের জন্য একই কাজ করতে পারবেন। এজন্যই ক্যালিফোর্নিয়া তার বিরুদ্ধে মামলা করছে।'
এর আগে নিউজম ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন 'বেআইনি' বলে উল্লেখ করেন এবং জানান যে তারা এ বিষয়ে আদালতের আইনের আশ্রয় নেবেন।