কে বড়? বোয়িং ৭৭৭এক্স নাকি এয়ারবাস এ৩৮০?

বোয়িং ৭৭৭এক্স এখন শুধু বোয়িংয়ের একদম নতুন উড়োজাহাজ প্রকল্পই নয়, বরং কিছু সূচকে ওয়াশিংটনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিমান নকশাগুলোর মধ্যে একটি হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
বোয়িং ৭৪৭-৮ থেকে একটু ছোট ফিউজেলাজ (বিমানের মূল কাঠামো) এবং হালকা ওজনের এই বিমানটি প্রযুক্তি ও ডিজাইনে বেশ কিছু দিক দিয়ে আলাদা। তবে এর ৭৭৭-৯ সংস্করণটি একটু বড়, সেই সঙ্গে ডানার দৈর্ঘ্যও বেশি—যদিও তা উইংটিপ এক্সটেনশন বা ডানার বাড়তি অংশসহ।
বিমান প্রস্তুতকারী কোম্পানি 'এয়ারবাস'-এর প্রযোজনে থাকা সবচেয়ে বড় বিমান এ৩৫০-১০০০, যা আকারে ৭৭৭এক্স থেকে কিছুটা ছোট এবং প্রায় ৭৭৭-৩০০ইআর-এর সমান। তবে এয়ারবাসের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মডেল হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে বিশালাকৃতির এ৩৮০।
দুই তলা বিশিষ্ট এই বিশাল বিমানটি এখনও আকাশপথের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ এবং 'প্রচলিত' বিমানগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ। তবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজের মুকুট পরে আছে আন্তোনভ এএন-২২৫ ম্রিয়া, যদিও তা বর্তমানে বিধ্বস্ত।
তবে, বোয়িং ৭৭৭এক্স আর এয়ারবাস এ৩৮০—আকাশপথের এই দুই বিশাল উড়োজাহাজের মুখোমুখি তুলনা কেমন?
আকারে এগিয়ে ৭৭৭এক্স
বোয়িং ৭৭৭-৯ মডেলের দৈর্ঘ্য ৭৬ দশমিক ৭৩ মিটার, যা এটিকে বর্তমানে প্রযোজনে থাকা দীর্ঘতম যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর আগে এই শিরোপা ছিল বোয়িং ৭৪৭-৮-এর, যার দৈর্ঘ্য ৭৬ দশমিক ২৫ মিটার। অন্যদিকে, এয়ারবাস এ৩৮০-এর দৈর্ঘ্য ৭২ দশমিক ৭৩ মিটার, অর্থাৎ বোয়িং ৭৭৭-৯ থেকে প্রায় চার মিটার ছোট।

যদিও আকারের দিক থেকে এ৩৮০ বিশাল, তিবে দৈর্ঘ্যের হিসেবে এটি হার মেনেছে বেশ কয়েকটি মডেলের কাছে। যেমন, বোয়িং ৭৭৭-৯ ও ৭৪৭-৮ ছাড়াও ৭৭৭-৩০০ইআর মডেলের দৈর্ঘ্য ৭৩ দশমিক ৯ মিটার, যা এ৩৮০-এর চেয়ে বেশি। এমনকি এয়ারবাসের এ৩৫০-১০০০ এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া এ৩৪০-৬০০ মডেলও (৭৫ দশমিক ৪ মিটার) এ৩৮০-কে ছাড়িয়ে গেছে।
এ৩৮০-এর তুলনামূলকভাবে ছোট হওয়ার মূল কারণ, এই এয়ারবাসটির নকশা মূলত আরও বড় আকারের এ৩৮০-৯০০ মডেলের জন্য তৈরি করা হয়েছিল । সেই বড় মডেল বাস্তবায়িত হলে প্রতি আসনে খরচ কম হতো। পরে এ৩৮০-৮০০-এর ছোট মডেল চালু হলে অর্থনৈতিকভাবে কিছু সুবিধা মিললেও শেষমেশ প্রকল্পটির সফলতা ব্যাহত হয়।
এয়ারবাসের এই সিদ্ধান্ত বোয়িংয়ের ৭৪৭এসপি বা এয়ারবাসের এ৩২০-এর ছোট সংস্করণ দিয়ে শুরু করার মতোই ছিল। তবে নকশাগত সীমাবদ্ধতা, সেই সাথে নানা প্রতিকূলতা মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত এ৩৮০ প্রকল্পটি সফল হতে পারেনি।
বাকি সব দিক থেকে এগিয়ে এ৩৮০
বোয়িং ৭৭৭-৯-এর ডানার প্রশস্ততা বোয়িং ৭৪৭-এর সব সংস্করণের চেয়ে বেশি। ৭৪৭-৮ মডেলের ডানার বিস্তৃতি ৬৮ দশমিক ৪ মিটার, যেখানে ৭৭৭-৯-এর ডানার বিস্তৃতি ৭১ দশমিক ৭৫ মিটার। যাত্রীবাহী বিমানের মধ্যে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডানার বিস্তৃতি—তবে এ ক্ষেত্রে কেবল এয়ারবাসের এ৩৮০-ই এগিয়ে।
এ৩৮০-এর ডানার প্রশস্ততা ৭৯ দশমিক ৭৫ মিটার, যা ইতিহাসের কয়েকটি বিশাল বিমান—যেমন আন্তোনভ এএন-২২৫, হিউগস এইচ-৪ হারকিউলিস আর স্ট্র্যাটোলঞ্চ-এর চেয়ে ছোট।

ডানার বিস্তৃতির পাশাপাশি ওজন বহনের ক্ষমতাতেও এয়ারবাস এ৩৮০ বোয়িং ৭৭৭এক্স-কে ছাড়িয়ে গেছে। বোয়িং ৭৭৭-৯-এর ম্যাক্সিমাম টেকঅফ ওয়েইট (এমটিওডব্লিউ) ৩৫১ টন, তবে ৭৭৭-৮এফ এর ক্ষেত্রে এটি ৩৬৫ টন পর্যন্ত বাড়তে পারে।
তুলনায়, এয়ারবাস এ৩৮০ মোট ৫৭৫ টন পর্যন্ত ওজন বহন করতে সক্ষম। বোয়িং ৭৪৭-এর সাম্প্রতিক সংস্করণগুলোর মধ্যে ৭৪৭-৮ মডেলের এমটিওডব্লিউ ৪৪৭ টন। পাশাপাশি, উচ্চতাতেও এয়ারবাস এ৩৮০ বোয়িং ৭৭৭এক্স থেকে অনেক বড়।
বোয়িং ৭৭৭এক্স-এর ম্যাক্সিমাম টেকঅফ ওয়েইট (এমটিওডব্লিউ) মূলত আগের ৭৭৭ সিরিজের মতোই আছে। তবে এর নকশায় এসেছে বড় পরিবর্তন—নতুন ডানা, নতুন ভার্টিকাল স্ট্যাবিলাইজার, নতুন ইঞ্জিন, নতুন অভ্যন্তরীণ বিন্যাসসহ আরও নানা দিক থেকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
এই নতুন টেইলপিস লম্বায় ১৯ দশমিক ৫৩ মিটার, যেখানে আগের ৭৭৭-এর টেইলপিসের উচ্চতা ছিল ১৮ দশমিক ৫ মিটার। এভাবে বহু পরিবর্তনের কারণে বোয়িং ৭৭৭এক্স-কে যে কোনও উড়োজাহাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় 'রিফ্রেশ' বলা চলে, যা এয়ারবাসের এ৩০০ থেকে এ৩৩০ মডেলের পরিবর্তনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
বোয়িং ৭৭৭ পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে সফল মডেল হলো ৭৭৭-৩০০ইআর, যা এককভাবে ৮০০টিরও বেশি বিক্রি হয়েছে। এর সাফল্যেই মূলত চার ইঞ্জিনের বড় বিমানের যুগ প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে।তাছাড়া, অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ ও ওজনের কারণে এয়ারবাসের এ৩৪০-৬০০ মডেলটি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি।
তবে যখন এয়ারবাস নতুন এ৩৫০ মডেল নিয়ে আসে, যা আকারে ৭৭৭-এর সমান হলেও কার্বন-কম্পোজিট কাঠামো ও উন্নত ইঞ্জিনে তৈরি, তখন এটি বোয়িংয়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তখন বোয়িংয়ের ছোট মডেলগুলো এয়ারবাসের এ৩৩০-৩০০ মডেলের সাথেও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছিল।
নতুন এ৩৫০ এক্সডব্লিউবি ৭৭৭-এর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। এর জবাবে বোয়িং ৭৭৭-এর অন্যতম দুর্বলতা—তুলনামূলক ছোট ডানার আকার—পুনর্নকশা করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে। যদিও এ৩৫০ পুরোপুরি নতুন নকশার একটি উড়োজাহাজ, তবুও বোয়িংয়ের জন্য এটি ছিল বড় পরীক্ষা।
বোয়িং ৭৭৭এক্স-এর ডানার আকার বড় করা হয়েছে জ্বালানি খরচ কমানোর জন্য। অন্যদিকে, ফিউজেলাজের আকার বাড়ানো হয়েছে যাতে আসন প্রতি খরচ কমানো যায়।
এয়ারবাস ও বোয়িং সাধারণত সরাসরি প্রতিযোগিতায় না গিয়ে নিজেদের জন্য আলাদা বাজার তৈরি করতে চায়। তাই ৭৭৭এক্স-এর আকার ও নকশা বড় করে নতুন বাজারে জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
এর প্রমাণ মিলছে অর্ডারের ধরনে—যে সব এয়ারলাইন্স এ৩৫০ চালায়, তারাও ৭৭৭এক্স অর্ডার করছে। কারণ, ৭৭৭এক্সে প্রথম শ্রেণির কেবিনের সুযোগ রয়েছে, যা অনেক যাত্রীর পছন্দ।
এরই মধ্যে বলা হয়েছে, ৭৭৭এক্স-এর ফ্লোর স্পেস এ৩৫০-১০০০-এর তুলনায় বড়। ফলে, এর জন্য আলাদা বাজার তৈরি হয়েছে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ যেমন ৭৭৭এক্স ব্যবহার করছে, তেমনই একইসাথে এ৩৫০-১০০০-ও পরিচালনা করছে।
তবে, তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৭৭৭এক্স-এ প্রথম শ্রেণির সেবা থাকবে, আর এ৩৫০-১০০০-এ শুধু বিজনেস ক্লাস থাকবে। ক্যাথে প্যাসিফিক ও কাতার এয়ারওয়েজও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
৭৭৭এক্স-এর বড় আকারের কারণে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অনেকে একে এয়ারবাস এ৩৮০-এর সঙ্গেও তুলনা করছে। তবে, আকারের দিক থেকে বড়ই নয়, অর্ডারবুকের দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে।
৫০০টির বেশি অর্ডারের মধ্যে ২০৫টি এসেছে এমিরেটসের কাছ থেকে। আসলে, মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইন্সগুলো ৭৭৭এক্সের নকশায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাদের এমন একটি বিমান দরকার ছিল, যা দীর্ঘ দূরত্বে এবং উষ্ণ ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় বিমানবন্দর থেকে সহজে উড়তে পারে।
তবে, এত বড় আকারের কারণে ৭৭৭এক্স তুলনামূলকভাবে অনেক ভারী হয়ে গেছে। ডানার ও পুরনো ফিউজেলাজের ওজন কমানোর জন্য ফিউজেলাজ কিছুটা বড় করা হয়েছে, যাতে আসনপ্রতি খরচ কমানো যায়। কিন্তু এতে বিমান পুরোপুরি ভর্তি করাই কঠিন হয়ে পড়ছে, বিশেষ করে এ৩৫০-১০০০-এর তুলনায়।
তবুও, ৭৭৭এক্স কেনা হচ্ছে। কারণ এর অর্ডারের সংখ্যা এখনো এ৩৮০-এর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। তবে, বাজারে এ৩৫০-১০০০-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা এখনো কঠিনই।

৭৭৭এক্স-এ রয়েছে জেনারেল ইলেকট্রিকের নতুন জিইনাইনএক্স ইঞ্জিন। এটি আগের জিই৯০ ইঞ্জিনের চেয়ে আকারে বড় এবং বেশি শক্তিশালী হলেও, রেটিং কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে যাতে ইঞ্জিনের ওপর চাপ কমে। নতুন প্রযুক্তির উপকরণ দিয়ে তৈরি হওয়ায় এই ইঞ্জিন সহজেই উচ্চ চাপ ও তাপমাত্রা সামলাতে পারে, ফলে জ্বালানি খরচও কমে আসে।
৭৭৭এক্স-এর কেবিনও সম্পূর্ণ নতুনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। আধুনিক আলো ব্যবস্থা ছাড়াও বড় জানালাগুলোয় ডিম করার সুবিধা রাখা হয়েছে। ক্যাবিনের উচ্চতা কমিয়ে যাত্রীদের আরাম বাড়ানো হয়েছে। যদিও প্রেশার ৭৮৭-এর মতোই রাখা হয়েছে, পাশের দেয়ালগুলো নতুনভাবে ঢালাই করা হয়েছে যাতে ক্যাবিনের প্রস্থ বাড়ে। এতে হয়তো আসনের আকার বড় হবে না, তবে রাস্তাগুলো প্রশস্ত হবে, যা যাত্রীদের চলাচল আরও সহজ করবে।
সামনের ককপিটও নতুনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যা দেখতে অনেকটা ৭৮৭-এর মতো। এতে ৭৭৭ এবং ৭৮৭ উভয় মডেলের পাইলটদের প্রশিক্ষণ সহজ হবে। কিছু ক্ষেত্রে একই রেটিংও দেওয়া হবে, যাতে প্রশিক্ষণ আরও দ্রুত ও কার্যকরী হয়। এছাড়া, সফটওয়্যারও আপডেট করা হয়েছে, ফলে ৭৭৭এক্স পাইলটদের জন্য আরও ব্যবহারবান্ধব হয়ে উঠবে।
তাহলে এগিয়ে থাকছে কে?
বোয়িং ৭৭৭এক্স এখন বাজারে পাওয়া সবচেয়ে বড় এয়ারলাইনার। এটি দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে সব বোয়িং বিমানের থেকে বড়। তবে এয়ারবাস এ৩৮০ এখনও বিশ্বের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী বিমান হিসেবেই আছে।
তবে এয়ারলাইন্সের জন্য শুধু আকার নয়, খরচই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ৭৭৭এক্সের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন এয়ারবাস এ৩৫০—যা নতুন, অনেক সাশ্রয়ী এবং ইতোমধ্যেই বাজারের বড় অংশ দখল করে ফেলেছে।

বেশি আসন থাকলে বেশি টিকেট বিক্রি করা সম্ভব হয়, ফলে টিকেটের দাম কম থাকে। একই খরচে যদি ছোট এবং বড় দুই ধরণের বিমান থাকে, এয়ারলাইন্স সাধারণত ছোট বিমান বেছে নেয় কারণ এতে ঝুঁকি কম থাকে। তাই বড় বিমান ভালো ব্যবসা করতে চাইলে অনেক বেশি সাশ্রয়ী হতে হয়।
৭৭৭এক্স কিছু এয়ারলাইন্সে বিক্রি হয়েছে আকারের কারণে; এটি এত বড় নয় যে পুরোপুরি বাজারহীন হয়ে পড়ে। তবে যখন এর কার্যত ব্যবহার শুরু হবে, তখন এর পরিচালন খরচ এয়ারবাস এ৩৫০-এর সঙ্গে তুলনা করে দেখা হবে বড় বিমান কেনা কতটা যৌক্তিক। এরপর সময়ই বলবে ৭৭৭এক্স-এর আকার তার জন্য সুবিধা নাকি বড় সমস্যার কারণ।