৪ হাজার মাইল সাঁতরে যেভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করলো বুল শার্কটি

গত গ্রীষ্মে নাইজেরিয়ার লাগোসের কাছে একটি বুল শার্ক ধরেন তুরাওয়া হাকিম। কিন্তু ঘানার এই জেলে তখনও বুঝতেই পারেননি যে তিনি রেকর্ডধারী একটি প্রাণীকে তার মাছ ধরার নৌকায় তুলেছেন!
আট ফুট লম্বা এই মা বুল শার্কটি পাড়ি দিয়েছে অন্তত ৪,৫০০ মাইল। এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা এ প্রজাতির হাঙরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ পথ পারি দিয়েছে সে। তাছাড়া বুল শার্ক নিয়ে করা তথ্য চিত্রগুলোর মধ্যে এ মা শার্কটিই প্রথম দুটি মহাসাগর পাড়ি দিয়েছে।
চলতি মাসে ইকোলজি নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, হাঙরটি প্রথমে ভারত মহাসাগরের মোজাম্বিক চ্যানেল থেকে যাত্রা শুরু করে, আফ্রিকার দক্ষিণপ্রান্ত ঘুরে আটলান্টিক মহাসাগর ধরে উত্তর দিকে নাইজেরিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছে।
হাকিম বলেন, "আমি অবাক হয়েছি। আমি জানতামই না যে ওরা এত দূর যেতে পারে!"
হাকিমের ফিশিং বোটের নাবিকরা যখন হাঙরটিকে বিক্রির জন্য এর মাংস কাটতে শুরু করে, তারা এটির ভেতরে একটি ছোট কালো সিলিন্ডার সদৃশ বস্তু দেখতে পান। সিলিন্ডারটিতে লেখা ছিল: 'গবেষণা: ফেরত দিলে পুরস্কার'।
কৌতূহলী হয়ে হাকিম ওই ঠিকানায় ই-মেইল পাঠান।
তিনি গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক এবং ওশেনোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হাঙর বিশেষজ্ঞ রায়ান ড্যালির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই ইনস্টিটিউট পশ্চিম ভারত মহাসাগরে গবেষণা পরিচালনা করে। ড্যালি ২০২১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এই বুল শার্কের দেহে ওই শব্দের সেন্সর বসিয়েছিলেন।
ড্যালিও প্রথমে এতটাই অবাক হয়েছিলেন যে তিনি ভেবেছিলেন কেউ হয়তো প্রতারণা করছে।
ড্যালি স্বীকার করে বলেন, "এমন হওয়ার সম্ভাবনা মিলিয়নে একটি।"
এই গবেষণার ফলে আমরা এখন বুল শার্কের গতিবিধি সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য জানতে পারছি।
হাঙরটি যেভাবে অন্য মহাসাগরে প্রবেশ করল
নাইজেরিয়ার সমুদ্রবিদ্যা ও সামুদ্রিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী দুনসিন আবিম্বোলা বোলাজি হাকিমের গল্পের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
মাছটির দেহে ট্র্যাকার বসানোর পর পরবর্তী এক বছরে এটি দক্ষিণ আফ্রিকা ও মোজাম্বিকের পূর্ব উপকূলে পানির নিচে ৪৩টি স্থান থেকে রিসিভারের মাধ্যমে ৫৬৭ বার তার সিগন্যাল শনাক্ত করা হয়।
এরপর ২০২২ সালের ২৫ মার্চে হাঙরটি অদৃশ্য হয়ে যায়। গত বছর ১১ জুলাই হাকিমের জালে হাঙরটি ধরার পরার আগ পর্যন্ত আর এর দেখা পাওয়া যায়নি।
হাঙরের অভিবাসন গবেষণার অংশ হিসেবে, ড্যালি ও তার সহকর্মীরা দক্ষিণ আফ্রিকায় ১০২টি বুল শার্ক, ব্ল্যাকটিপ শার্ক, টাইগার শার্ক এবং রিফ শার্কে ট্র্যাক করে সেগুলোর গতিবিধির দিকে নজর রাখছিলেন। এই হাঙরগুলোর মধ্যে দীর্ঘতম অভিবাসন ছিল ১,৪০০ মাইল, যা লাগোসের কাছে ধরা পড়া ওই মা বুল শার্কের চলাচলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মাত্র।
বুল শার্ক মূলত উপকূলীয় প্রজাতির হাঙর। তবে সাধারণত মুক্ত মহাসাগরে খুব বেশি দীর্ঘপথ পাড়ি দেয় না। তারা অগভীর পানিতে বিচরণ করতে পছন্দ করে, যেখানে মিঠাপানি সমুদ্রের লবণাক্ত পানির সঙ্গে এসে মিলিত হয়। আর তাদের থাকার জন্য পানির তাপমাত্রা ৬৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি থাকতে হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, উত্তরের যাত্রাপথে ওই মা বুল শার্ককে বেঙ্গুয়েলা আপওয়েলিং পার হতে হয়েছিল, একটি বৃহৎ ঠান্ডা পানির প্রবাহ, যা দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়ার পশ্চিম উপকূল বরাবর বিস্তৃত। গত ৫৫ হাজার বছর ধরে এই ঠান্ডা প্রবাহটি আফ্রিকার বুল শার্কের প্রজাতিগুলোকে আলাদা করে রাখার মতো একটি শীতল বাধা হিসেবে কাজ করেছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন শার্কটি এই ঠান্ডা জলের বাধা এড়িয়ে আপওয়েলিংয়ের চারপাশ দিয়ে সাঁতার কেটে গিয়েছিল, যা উপকূল থেকে ৯০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
এছাড়াও বেঙ্গুয়েলা নিয়ানো ইভেন্টের সময় দক্ষিণ আফ্রিকার চারপাশে উষ্ণ পানির জায়গাগুলো ধরেও সে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।