বিশ্বের প্রথম ড্রোন যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা

দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিশ্বের প্রথম ড্রোন যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ভারত দাবি করে, তাদের তিনটি সামরিক ঘাঁটি ও ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর লক্ষ্য করে পাকিস্তান একাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তবে ইসলামাবাদ দ্রুতই এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
পাকিস্তানের দাবি, গত কয়েক ঘণ্টায় তারা ভারতের ২৫টি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য আসেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাল্টাপাল্টি হামলা দুই দেশের দীর্ঘদিনের বৈরি সম্পর্ককে নতুন ও বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এবার আর কেবল গোলাবর্ষণ নয়, ড্রোনের মতো মানব চালকবিহীন অস্ত্রও সীমান্ত পার হয়ে আঘাত হানছে।
ওয়াশিংটনসহ আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলো উভয়পক্ষকে সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু এই দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা কমে যাবার কোনো লক্ষণ নেই। বরং, নীরব, দূরনিয়ন্ত্রিত ও সহজেই অস্বীকারযোগ্য ড্রোনই এখন ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের নতুন অধ্যায় উন্মোচন করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক জাহারা ম্যাটিসেক বিবিসিকে বলেন, 'ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এখন ড্রোন প্রযুক্তি নির্ভর এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে। এই ড্রোনের মতো 'অদৃশ্য চোখ' ও মানববিহীন সুনির্দিষ্ট অস্ত্রের ব্যবহারই যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি ঠিক করে দেবে। দক্ষিণ এশিয়ার এই বিরোধপূর্ণ আকাশে যে দেশ ড্রোন যুদ্ধের কৌশল ভালোভাবে রপ্ত করতে পারবে, তারা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের দর্শক হবে না বরং সেটিকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করবে।'
পাকিস্তানের দাবি করছে বুধবার সকাল থেকে ভারতীয় বিমান হামলা ও সীমান্ত পারের গোলাবর্ষণে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে অন্তত ৩৬ জন নিহত এবং আরও ৫৭ জন আহত হয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে ভারতের সেনাবাহিনী অন্তত ১৬ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে।
ভারতের দাবি, গত মাসে পেহেলগামে ভারতীয় পর্যটকদের ওপর চালানো প্রাণঘাতী জঙ্গি হামলার প্রতিশোধ হিসেবেই এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। তবে ইসলামাবাদ ওই হামলায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জানায়, তারা করাচি, লাহোর ও রাওয়ালপিন্ডিসহ বিভিন্ন শহরে ভারতের ২৫টি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। তাদের দাবি, ড্রোনগুলো ছিল ইসরায়েলের তৈরি হ্যারপ ড্রোন, যেগুলো প্রযুক্তিগত ও অস্ত্রভিত্তিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা প্রতিহত করেছে।
অন্যদিকে, ভারত জানিয়েছে, তারা পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি বিমান প্রতিরক্ষা রাডার ও ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে, যার মধ্যে লাহোরের একটি রাডারও রয়েছে। তবে ইসলামাবাদ এই দাবি অস্বীকার করেছে।
আধুনিক যুদ্ধে লেজার-নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা, ড্রোন এবং মানববিহীন আকাশযান (ইউএভি) এখন গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এমন প্রযুক্তি সামরিক অভিযানের নির্ভুলতা ও কার্যকারিতা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব ড্রোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান জানাতে পারে, কিংবা সরাসরি লেজার দিয়ে লক্ষ্য চিহ্নিত করে হামলার সুযোগ করে দেয়।
ড্রোন কখনো কখনো শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে ফাঁদ হিসেবে অথবা তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল করতে ব্যবহৃত হয়। এগুলো শত্রু-নিয়ন্ত্রিত আকাশসীমায় প্রবেশ করে রাডারকে সক্রিয় করে। পরে সেই রাডারগুলোকে নিশানা করা হয় 'লয়টারিং' ড্রোন বা 'অ্যান্টি-রেডিয়েশন' ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে।
অধ্যাপক ম্যাটিসেক বলেন, 'এই পদ্ধতিই বর্তমানে ইউক্রেন ও রাশিয়া তাদের যুদ্ধে ব্যবহার করছে। এসব ড্রোন একদিকে লক্ষ্য চিহ্নিত করে, অন্যদিকে শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করে তোলে। এই দ্বৈত শক্তি আক্রমণের তীব্রতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এতে করে মানববাহী বিমানকে ঝুঁকিতে না ফেলেই শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল করা সম্ভব হয়।'
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ড্রোনবহর বেশিরভাগই ইসরায়েল নির্মিত রিকনিসেন্স ইউএভি (মানববিহীন আকাশযান) ধাঁচের। এর মধ্যে রয়েছে আইএআই সার্চার এবং হেরন। পাশাপাশি রয়েছে হ্যারপি এবং হ্যারপ লয়টারিং মিউনিশন—যেগুলো ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবেও কাজ করে। এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে গোয়েন্দা অনুসন্ধান এবং নিখুঁত আক্রমণ করতে সক্ষম। বিশেষত, হ্যারপ ড্রোনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক আক্রমণের ক্ষমতার ফলে আধুনিক যুদ্ধে আধুনিক যুদ্ধে এর গুরুত্ব বেড়েই চলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হেরন ড্রোন ভারতের জন্য 'উঁচু আকাশ থেকে নজরদারি করা চোখ'। এটি শান্তিকালীন পর্যবেক্ষণ ও যুদ্ধকালীন অভিযানে সমানভাবে ব্যবহৃত হয়।
'আইএআই সার্চার এমকে টু' মূলত সামনের সারির অভিযান পরিচালনার জন্য তৈরি। এটি টানা ১৮ ঘণ্টা উড়তে পারে। এর কার্যপরিধি ৩০০ কিলোমিটার (১৮৬ মাইল)। সর্বোচ্চ উড্ডয়ন উচ্চতা ৭ হাজার মিটার (২৩ হাজার ফুট)।
অনেকে মনে করেন, ভারতের যুদ্ধ ড্রোনের সংখ্যা এখনও 'সীমিত'। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারে ৩১টি এমকে-৯বি প্রিডেটর ড্রোন কেনার চুক্তি হয়েছে, যা ভারতের হামলার সক্ষমতায় বড় ধরনের অগ্রগতি। এই ড্রোনগুলো একটানা ৪০ ঘণ্টা উড়তে এবং সর্বোচ্চ ৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম।
এছাড়া, ভারত এখন 'সোয়ার্ম ড্রোন' কৌশলও তৈরি করছে। এতে বহু ছোট ইউএভি একসঙ্গে ছেড়ে শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যস্ত ও বিপর্যস্ত করা হয়, যাতে মূল্যবান যুদ্ধবিমানগুলো সহজে শত্রুর আকাশসীমায় প্রবেশ করতে পারে।
লাহোরভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ইজাজ হায়দার বিবিসিকে জানান, পাকিস্তানের ড্রোন বহর 'ব্যাপক এবং বৈচিত্র্যময়'। এতে দেশীয় ও বিদেশি দুই ধরনের প্রযুক্তি রয়েছে। তিনি জানান, পাকিস্তানের ভান্ডারে চীন, তুরস্ক এবং দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এক হাজারের বেশি ড্রোন আছে।
এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চীনের সিএইচ-৪, তুরস্কের বাইরাকতার আকিনচি এবং পাকিস্তানের নিজস্ব তৈরি বুরাক ও শাহপার ড্রোন। এছাড়াও পাকিস্তান লয়টারিং মিউনিশন প্রযুক্তিও তৈরি করেছে, যা তাদের আক্রমণক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে।
তিনি জানান, প্রায় এক দশক ধরে পাকিস্তান বিমান বাহিনী (পিএএফ) তাদের অভিযানে মানব চালনবিহীন প্রযুক্তি সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত করছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো, 'লয়াল উইংম্যান' ড্রোন তৈরি করা, যা মানবচালিত যুদ্ধবিমানের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে পারে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক জাহারা ম্যাটিসেক মনে করেন, ভারতের জন্য ইসরায়েলের কারিগরি সহায়তা, বিশেষ করে হ্যারপ ও হেরন ড্রোন সরবরাহ—গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর পাকিস্তান নির্ভর করছে তুরস্ক ও চীনের প্রযুক্তির ওপর । এটি দেশ দুটির মধ্যে চলমান অস্ত্র প্রতিযোগিতারই প্রতিফলন বলে তিনি মনে করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ড্রোন হামলা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একটি বড় উত্তেজনার ইঙ্গিত দিলেও, এটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ড্রোনকেন্দ্রিক যুদ্ধ কৌশল থেকে অনেকটাই ভিন্ন। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে ড্রোনই মূল অস্ত্র হয়ে উঠেছে—উভয় পক্ষই হাজার হাজার ইউএভি ব্যবহার করছে নজরদারি, লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিতকরণ ও সরাসরি হামলার কাজে।

ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মনোজ যোশী বিবিসিকে বলেন, 'এই সংঘাতে যুদ্ধবিমান বা ভারী ক্ষেপণাস্ত্রের পরিবর্তে ড্রোন ব্যবহার এক ধরনের সীমিত সামরিক কৌশল। ড্রোনে ভারী অস্ত্র থাকে না, তাই এক অর্থে এটি কিছুটা সংযত পদক্ষেপ। তবে যদি এটি বৃহত্তর আকাশযুদ্ধের সূচনা হয়, তাহলে পুরো পরিস্থিতির হিসাবই পাল্টে যাবে।'
ইজাজ হায়দারের মতে, জম্মুতে সম্প্রতি যে ড্রোন কার্যক্রম দেখা গেছে, তা সম্ভবত কোনো বড় ধরনের প্রতিশোধ নয়, বরং তাৎক্ষণিক উসকানির জবাবে পাকিস্তানের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।
তিনি বলেন, 'ভারতের বিরুদ্ধে যদি প্রকৃত প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো হতো, তবে তা হতো বিস্ময়কর ও প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক। তাতে মানবচালিত যান ও ড্রোন সবই ব্যবহার হতো এবং আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু আরও বিস্তৃত হতো। এ ধরনের অভিযান বড় ধরনের সামরিক উত্তেজনার ইঙ্গিত দিত, বর্তমান সময়ের পাল্টাপাল্টি হামলার পরিস্থিতি থেকে সেটি হতো অনেকটাই আলদা।'
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেনে ড্রোনগুলো যুদ্ধের ক্ষেত্রকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করলেও, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে তাদের ভূমিকা এখনও সীমিত এবং প্রতীকী। উভয় দেশই একে অপরকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে তাদের মানবচালিত বিমান বাহিনী ব্যবহার করছে।
মনোজ যোশী বলেন, 'আমরা যা ড্রোন যুদ্ধ দেখছি, তা দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে; এটি হয়তো একটি বৃহত্তর সংঘর্ষের প্রারম্ভমাত্র।'
'এটি হয়তো যুদ্ধ বাড়ার কিংবা কমার, যেকোন একটির সংকেত হতে পারে। এখানে দুটি সম্ভাবনা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। আমরা একটি মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি; এখান থেকে আমরা কোন পথে এগোবো, তা অনিশ্চিত।'
স্পষ্টতই ভারত তার সুনির্দিষ্ট আক্রমণ কৌশলে ড্রোনগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করছে, যা সীমান্ত অতিক্রম না করেই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম করে। তবে এই পরিবর্তনটি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও উত্থাপন করছে।
অধ্যাপক ম্যাটিসেক বলেন, 'ড্রোনগুলো রাজনৈতিক ও কার্যকরী সীমা কমিয়ে দেয়, যা নজরদারি ও আক্রমণ করার সুযোগ দেয়, কিন্তু হামলা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করে।'
'তবে একই সঙ্গে এটি নতুন ধরনের উত্তেজনার পথও খুলে দেয়—প্রতিটি ড্রোন ভূপাতিত হওয়া, প্রতিটি রাডার নিঃক্রিয় হওয়া, এই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত দুই দেশের মাঝে যে কোনো মুহূর্তে বড় সংঘর্ষের কারণ হয়ে উঠতে পারে', যোগ করেন তিনি।