‘ভীতিকর গোয়েন্দা তথ্য’ পেয়ে যুদ্ধবিরতির জন্য মোদিকে ফোন দেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দল পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। শুক্রবার (৯ মে) সকালে ওয়াশিংটনের কাছে এক 'ভীতিকর গোয়েন্দা তথ্য' পৌঁছানোর পর এই নজরদারি আরও জোরদার হয় বলে সিএনএনকে জানিয়েছেন ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
ওই গোয়েন্দা তথ্যের প্রকৃতি বিস্তারিতভাবে না জানালেও কর্মকর্তারা জানান, তা এতটাই স্পর্শকাতর ছিল যে, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্তর্বর্তী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্কো রুবিও এবং হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ সুজি ওয়াইলস তাৎক্ষণিকভাবে আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায়, ভ্যান্স সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বরাতে জানানো হয়, ভ্যান্স প্রথমে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পুরো পরিকল্পনার বিষয়ে ব্রিফ করেন। এরপর শুক্রবার মার্কিন সময় দুপুর ১২টায় মোদির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন।
ফোনালাপে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, সপ্তাহান্তের দিকে সংকট আরও গভীরতর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। ভ্যান্স মোদিকে উৎসাহিত করেন যেন ভারত সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং উত্তেজনা প্রশমনের পথ খোঁজে।
মার্কিন কর্মকর্তারা আরও জানান, এই গোপন কূটনৈতিক তৎপরতার বিস্তারিত আগে কখনো প্রকাশ্যে আসেনি।
ওই সময়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান—একেবারেই যোগাযোগে ছিল না। ফলে তাদের আবার আলোচনার টেবিলে ফেরানো জরুরি হয়ে পড়ে। ভ্যান্স ফোনালাপে মোদিকে একটি সম্ভাব্য সমঝোতার পথ বা 'অফ-র্যাম্প' তুলে ধরেন, যেটিকে পাকিস্তান গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করছিল। তবে কর্মকর্তারা এই প্রস্তাবের বিস্তারিত কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
মোদির সঙ্গে ভ্যান্সের ফোনালাপের পর, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা—যাদের মধ্যে রুবিও ছিলেন—ভারত ও পাকিস্তানের নিজ নিজ সমকক্ষদের সঙ্গে মধ্যরাত পর্যন্ত ফোনে যোগাযোগ চালিয়ে যান।
সূত্রগুলো জানায়, রুবিও আগেই, সপ্তাহের শুরুতেই, আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন—যুদ্ধবিরতির একটি সাধারণ কাঠামো নিয়ে। তবে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করে দেয় যে, সমঝোতার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ভারত ও পাকিস্তানের নিজেদের মধ্যে নির্ধারণ করতে হবে।
'সপ্তাহের শুরু থেকেই উত্তেজনা প্রশমনের জন্য ব্যাপক চেষ্টা চলছিল। তখনও দুই দেশের মধ্যে কোনও কথা হচ্ছিল না, এটা পরিষ্কার ছিল,' বলেন একজন কর্মকর্তা, যিনি রুবিওর ফোনালাপ সম্পর্কে অবগত।
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য ছিল ভারত ও পাকিস্তানকে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগে উৎসাহিত করা এবং যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে উত্তেজনা হ্রাসের উপায় খুঁজে বের করতে সহায়তা করা। এই আলোচনার মধ্য দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষের সম্ভাব্য সমঝোতার রূপরেখা সম্পর্কে ধারণা পায় এবং সেটি এক পক্ষ থেকে অন্য পক্ষের কাছে পৌঁছে দিয়ে যোগাযোগ ব্যবধানে সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে। এর ফলেই শেষ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে সরাসরি আলাপ সম্ভব হয়।'
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই সমঝোতার খসড়া তৈরিতে সরাসরি জড়িত ছিল না। বরং তাদের ভূমিকা ছিল দুই পক্ষকে আলোচনায় ফিরিয়ে আনার মতো 'সুবিধাকারী' হিসেবে। তবে মার্কিন দৃষ্টিকোণ থেকে মোদির সঙ্গে ভ্যান্সের ফোনালাপকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে দেখা হয়েছে।
ভ্যান্স এক মাস আগেই ভারত সফর করে মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসনের ধারণা ছিল, মোদির সঙ্গে ভ্যান্সের সেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক এই আলোচনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে লক্ষ্য করার মতো বিষয়, মোদির সঙ্গে এই গোপন ফোনালাপটি হয় মাত্র এক দিন পর, যেদিন ভ্যান্স প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, এই সংঘাত 'আমাদের কোনও বিষয় নয়'।
ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'আমরা যা করতে পারি তা হলো—তাদের সামান্য হলেও উত্তেজনা প্রশমনে উৎসাহিত করা। কিন্তু এমন একটি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতা করবে না, যা একেবারেই আমাদের বিষয় নয় এবং যার ওপর আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।'
'আমেরিকা ভারতকে অস্ত্র নামাতে বললে তারা শুনবে না, পাকিস্তানকেও একইভাবে নির্দেশ দিতে পারি না। তাই কূটনৈতিক পথেই আমরা বিষয়টি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব,' বলেন ভ্যান্স।
শনিবার একদিনের তীব্র সংঘর্ষের পর অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায় ভারত ও পাকিস্তান। তবে যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ কীভাবে হবে—তা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা। যুদ্ধবিরতির ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরেও ভারতশাসিত কাশ্মীর ও পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
শনিবার সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'সম্পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির' ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশালে এক পোস্টে ট্রাম্প লিখেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাতে দীর্ঘ আলোচনার পর উভয় দেশই পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।'
এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই পররাষ্ট্র সচিব ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (অন্তর্বর্তী) মার্কো রুবিও টুইট করেন, 'আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, ভারত ও পাকিস্তান সরকার তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে এবং নিরপেক্ষ স্থানে বিস্তৃত বিষয়ে আলোচনা শুরু করতে রাজি হয়েছে।'
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস জানান, গত ৪৮ ঘণ্টায় রুবিও ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের উদ্যোগে দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ কয়েক দফা আলাপের ফলেই এই যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছে। শনিবার নিউজনেশন-এ তিনি বলেন, 'এটি ছিল এক অসাধারণ অংশীদারিত্ব।' প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের 'দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা বাস্তবায়নে' ভ্যান্স ও রুবিওর ভূমিকাকে তিনি বিশেষভাবে প্রশংসা করেন।
পাকিস্তান এই মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রশংসা করলেও ভারত এ বিষয়ে নিশ্চুপ থেকেছে।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়ার প্রায় তিন ঘণ্টা পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এক্স-এ (সাবেক টুইটার) লেখেন, 'আঞ্চলিক শান্তির জন্য নেতৃত্ব ও সক্রিয় ভূমিকার কারণে আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানাই।'
তবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রি যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকাই উল্লেখ করেননি। বরং ভারত সরকারের বিবৃতিতে জানানো হয়, এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যকার 'সরাসরি আলোচনা'র মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে।
এই পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা নতুন কিছু নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তান বরাবরই আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার ব্যাপারে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। নিজেকে একটি উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে দেখানো ভারত বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপে অনাগ্রহী, বিপরীতে বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল পাকিস্তান প্রায়শই আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকে স্বাগত জানায়।