৯৯ বছরে পৌঁছে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা’ নিয়ে আসছেন প্রকৃতিবিদ অ্যাটেনবরো

শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতিবিদ, উপস্থাপক স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো নিয়ে আসছেন তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিল্মগুলোর একটি।
তার বিশ্বাস, নতুন এই পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আকারের ফিল্ম 'ওশান' জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বৃহস্পতিবার ৯৯ বছরে পা দিতে যাওয়া স্যার অ্যাটেনবরো বলেন, 'এ গ্রহে প্রায় এক শতাব্দী কাটানোর পর আমি বুঝেছি—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আসলে স্থলভাগে নয়, সমুদ্রে।'
এ চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে, সমুদ্রই এই গ্রহের সাপোর্ট সিস্টেম এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে মানবজাতির সবচেয়ে বড় মিত্র। পৃথিবীর সমুদ্রগুলো কীভাবে সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, তা দেখানো হয়েছে এই ফিল্মে।
ক্রিস মার্টিন ও কোল্ডপ্লে, বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ, নভোচারী টিম পিক, জেরি হলিওয়েল-হর্নার, সাইমন লেবন একঝাঁক তারকার উপস্থিতিতে হবে এই ছবির প্রিমিয়ার।
'ওশান'-এর প্রযোজক টোবি নাওল্যান বলছেন, এটি অ্যাটেনবরো প্রথাগত ডকুমেন্টারি নয়। 'এটা তার সবচেয়ে বড় বার্তা।'
ডেভিড অ্যাটেনবরোর জীবদ্দশায় কীভাবে পৃথিবীর সমুদ্রগুলোর অবস্থা এবং তাদের সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া আমূল বদলে গেছে, তা তুলে ধরেছে এই ফিল্ম।
১৯৫৭ সালে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে প্রথম স্কুবা ডাইভের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, 'ওই অপরূপ দৃশ্য দেহে আমি মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিলাম।'
কিন্তু সেই সৌন্দর্যের অনেকটাই আজ বিলীন হয়ে গেছে। সমুদ্রের জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। 'আমার হাতে সময় নেই বললেই চলে,' সতর্ক করে বলেন অ্যাটেনবরো।
'ওশান'-এ আছে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী চিত্র—কীভাবে বটম ট্রলিং নামক মাছ ধরার পদ্ধতি সমুদ্রতলকে ক্ষতবিক্ষত করছে। অ্যাটেনবরোর দাবি, মৎস্য শিকার শিল্প কীভাবে সমুদ্রের সমস্ত প্রাণ নিঃশেষ করে দিচ্ছে, তার উজ্জ্বল নজির এটি।
এই ফিল্মে দেখানো হয়েছে, ট্রলারের পেছনে বাঁধা ভারী শিকল কীভাবে সমুদ্রের তলদেশ আঁচড়ে তুলে নিচ্ছে সবকিছু। এতে জালে আটকা পড়ছে অসংখ্য প্রাণী। এভাবে ট্রলারগুলোর জালে ধরা পড়া চার ভাগের তিন ভাগ প্রাণীই শেষপর্যন্ত ফেলে দিতে হয়।
'মাছ ধরার এর চেয়ে অপচয়কর পদ্ধতি কল্পনা করাও কঠিন,' বলেন অ্যাটেনবরো।
এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইডও নিঃসরণ হয়, যা শুধু বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করে। তারপরও বটম ট্রলিং এখনও বৈধ, এবং অনেক সরকার এই পদ্ধতিকে উৎসাহই জুগিয়ে চলেছে।
সমুদ্রের করুণ অবস্থা দেখে পৃথিবীতে জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রায় আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন স্যার ডেভিড। কিন্তু তিনি পুরোপুরি ভেঙে পড়েননি এক 'অবিশ্বাস্য আবিষ্কারের' কারণে—'সমুদ্র আমাদের কল্পনার চেয়েও দ্রুতগতিতে সেরে উঠতে পারে'। এই আবিষ্কারই তাকে নতুন করে আশার আলো দেখিয়েছে।
ডেভিড অ্যাটেনবরো বলেন, তিমিদের গল্প তার মনকে ছুঁয়েছে গভীরভাবে। বিশ শতকে প্রায় ২.৯ মিলিয়ন তিমি হত্যা করে শিকারিরা। বিজ্ঞানীরা বলেন, মোট জীব ওজনের হিসাবে এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রাণী হত্যাকাণ্ড। শিকারের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, প্রায় সব প্রজাতির তিমি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে গিয়েছিল।
মাত্র ১ শতাংশ ব্লু হোয়েল (নীল তিমি) টিকে ছিল। সেই স্মৃতিচারণ করে অ্যাটেনবরো বলেন, 'আমি ভেবেছিলাম, সব শেষ। তিমিরা হারিয়ে গেল, আর ফিরবে না ওরা।'
কিন্তু ১৯৮৬ সালে জনগণের চাপে পড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক তিমি শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আর তখনই প্রকৃতি দেখায় তার আশ্চর্য ক্ষমতা—দ্রুত বাড়তে শুরু করে তিমিদের সংখ্যা।
'ওশান' ফিল্মে ডেভিড অ্যাটেনবরোর মূল বার্তা—সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। দেশগুলো বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্র রক্ষা করার অঙ্গীকার করেছে। অ্যাটেনবরোর আশা করছেন, আসন্ন জাতিসংঘ সম্মেলনে এই অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দিতে নেতারা এবার পদক্ষেপ নেবেন।
তিনি বলেন, 'সমুদ্রে প্রাণ ফিরতে পারে। সমুদ্রকে বিরক্ত না করলে শুধু প্রাণই ফিরে পাবে না, এমনভাবে বিকশিত হবে যা আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাবে।'
বিজ্ঞানীরাও বলছেন, সুস্থ সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র আরও বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বড় অস্ত্র হতে পারে।
ডেভিড অ্যাটেনবরো বলেন, 'আমাদের সামনে আমাদের আবহাওয়া, খাবার আর ঘর রক্ষা করার এক সুবর্ণ সুযোগ দাঁড়িয়ে আছে।'