যে কারণে চকলেট এত দামী হয়ে উঠছে

গত বছর কোকোর দাম প্রায় ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এবছর চকলেট বার ও কোকো পাউডারের দাম গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
ওয়েলস ফার্গো ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে এবারের ভালোবাসা দিবসে খুচরা চকলেটের দাম গত বছরের তুলনায় এক-পঞ্চমাংশ বেশি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া বড় আকারের 'রিস' হার্টস' চকলেট বারের দাম ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১৩ শতাংশ।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে ইস্টারের আগে সুপারমার্কেটগুলোতে 'টুইক্স হোয়াইট চকোলেট' ইস্টার ডিমের দাম ৬ দশমিক ৬৩ ডলার থেকে ৭ দশমিক ৯৬ ডলার হয়েছে, এবং এর ওজন ৩১৬ গ্রাম থেকে কমিয়ে ২৫৮ গ্রাম করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এর এক ইউনিটের দাম প্রায় ৪৭ শতাংশ বেড়েছে।
চকলেট তৈরির প্রধান উপাদান কোকোর দাম ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রায় ২০ শতাংশ কমলেও ভোক্তারা এখনো বাড়তি দামেই চকলেট কিনছেন।
কোকোর এই দাম বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো চরম আবহাওয়া, যা পশ্চিম আফ্রিকার কোকো উৎপাদনকারী দেশগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই অঞ্চল থেকেই বিশ্বের বেশিরভাগ কোকো আমদানি করা হয়।
পরিবেশবিষয়ক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক 'এনার্জি অ্যান্ড ক্লাইমেট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট' (ইসিআইইউ)-এর বিশ্লেষক অ্যাম্বার সোয়ারের মতে, চকলেটের দাম বেশি হওয়াটা মোটেও অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।
তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুধু চকলেট নয়, আরও অনেক খাবারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা আরও খারাপ হবে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে নিউ ইয়র্কের বেঞ্চমার্ক ফিউচারস কনট্রাক্ট অনুযায়ী কোকোর দাম মেট্রিক টনপ্রতি ১২ হাজার ৫৬৫ ডলার ছুঁয়েছিল।
গত বছরে কোকোর নিম্ম ফলনের জন্য সরবরাহে বিশাল ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ কোকো উৎপাদনকারী দেশ ঘানা ও আইভরি কোস্টে খারাপ আবহাওয়া ও রোগের কারণে কোকো ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়া, বিশ্বের তৃতীয় ও চতুর্থ বৃহত্তম কোকো উৎপাদক দেশ নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতেও ফসলের ঘাটতি দেখা গেছে। ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে মোট ৫ লাখ টন কোকোর ঘাটতি ছিল, যা এখনও দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত চলা সর্বশেষ কোকো মৌসুমের শুরুটা ভালোই হয়েছিল। কমার্সব্যাংকের বিশ্লেষক কারস্টেন ফ্রিৎস জানান, আইভরি কোস্টে কোকো বন্দরে আগত কাঁচামালের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি ছিল।
কোকোর দামে চরম অস্থিরতার কারণে সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত চকলেট কোম্পানি ব্যারি ক্যালাবাউট তাদের বার্ষিক বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এর ফলে কোম্পানির শেয়ারের দাম একদিনে প্রায় ২০ শতাংশ পড়ে যায়।
দামের ঊর্ধ্বগতির কারণ?
প্রধান কারণগুলোর একটি আবহাওয়ার অস্থিরতা। ২০২৩ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি পরিমান বৃষ্টি হয়েছে। আবার ২০২৪ সালে দেখা গেছে চরম গরম ও খরা।
অনেক জলবায়ু বিজ্ঞানী বলছেন, এই আবহাওয়ার অস্থিরতার মূল কারণ 'এল নিনো'—যা প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য ও পূর্বাংশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ তাপমাত্রার সৃষ্টি করে। তবে তারা আশা করছেন, প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর পর ঘটে যাওয়া 'লা নিনো'—যা সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ঠান্ডা করে—তা কমপক্ষে সাময়িকভাবে কোকো ফলনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

আন্তর্জাতিক কোকো সংস্থার (আইসিও) পূর্বাভাস অনুযায়ী, গত চার বছরে প্রথমবারের মতো ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী ১ লক্ষ ৪২ হাজার মেগাটন কোকো উদ্বৃত্ত থাকবে। আংশিকভাবে এই কারণেই সম্প্রতি কোকোর দামে কিছুটা পতন দেখা গেছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ক্লাইমেট সেন্ট্রাল'-এর বিজ্ঞানীরা একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, আইভরি কোস্ট ও ঘানায় কোকো চাষ মৌসুমে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কোকোগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আবহাওয়ার পরিবর্তনের পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় কোকোর সাম্প্রতিক দামের ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী। পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নতুন বন উজাড়বিরোধী আইন কার্যকর হওয়ায় কৃষকেরা কোকোর জমি সম্প্রসারণ করতে পারছেন না, ফলে সরবরাহ সীমিত থেকে যাচ্ছে।
এছাড়াও, এই অঞ্চলে কোকো গাছের একটি বড় অংশ এখন বৃদ্ধ, এবং সেগুলোর প্রতিস্থাপন হচ্ছে না। এদিকে, কোকো সোয়েলন শুট ভাইরাস (সিএসএসভি) ছড়িয়ে পড়ার ফলে কোকোর ফলন কমে গেছে।
বাজার গবেষণা সংস্থা ট্রপিক্যাল রিসার্চ সার্ভিসেস সম্প্রতি জানিয়েছে, এই ভাইরাসের বিস্তারের কারণে আইভরি কোস্টে কোকোর উৎপাদন অর্ধেক হয়ে যেতে পারে।
এছাড়া বিনিয়োগকারীরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতির ফলে সৃষ্ট আর্থিক অস্থিরতা থেকে বাঁচতে স্বর্ণ কিনে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। ঘানা আফ্রিকার শীর্ষ স্বর্ণ উৎপাদক এবং বিশ্বে ষষ্ঠ বৃহত্তম। ফলে অনেক কৃষক তাদের জমি অবৈধ খননকারীদের কাছে বিক্রি করছেন, যারা স্বর্ণের খোঁজে বিস্তীর্ণ জমি ধ্বংস করে ফেলেছে।
চকলেট কোম্পানিগুলোর প্রতিক্রিয়া
চকলেট উৎপাদকরা এখন পর্যন্ত দুইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে—বাড়তি খরচ গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অথবা এমন পণ্য বাজারে এনে, যাতে কম কোকো বা বিকল্প উপাদান বেশি ব্যবহার করা হয়েছে।
গত বছর খাদ্যপ্রতিষ্ঠান নেসলে তাদের ব্রিটিশ অ্যারো চকোলেট লাইনে ৩৬ গ্রাম ওজনের হ্যাজেলনাট ফ্লেভার যুক্ত করেছে, যা অন্যান্য প্রতিযোগী পণ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
২০২৪ সালে কৃষিভিত্তিক খাদ্যপ্রতিষ্ঠান কারগিল যুক্তরাষ্ট্রের কোকোর বিকল্প প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ভয়েজ ফুডস-এর সঙ্গে অংশীদারিত্ব করে। এই প্রতিষ্ঠানটি আঙ্গুর বীজ, সূর্যমুখী ফুলের ময়দা এবং অন্যান্য স্বাদ উপাদান দিয়ে কোকো-বিহীন চকোলেট বার তৈরি করে।
বড় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি, নুকোকো ও প্ল্যানেট এ নামের স্টার্টআপগুলো মাইক্রোবিয়াল ফারমেন্টেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে চকোলেটের গন্ধ ও স্বাদ উন্নত করার চেষ্টা করছে।
এদিকে, ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠিত দুবাই চকলেট পণ্যগুলোর মধ্যে পেস্তা ও তাহিনি (তিলের পেস্ট) ভরাট থাকে এবং এগুলো মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাজুড়ে জনপ্রিয় মিষ্টি 'কুনাফা' থেকে অনুপ্রাণিত। বাজারে আসার পর থেকেই এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে।