পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের দূতের চার ঘণ্টার বৈঠক, ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির আহ্বান

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূত স্টিভ উইটকফ শুক্রবার সেন্ট পিটার্সবার্গে এক দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। এর মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে পুতিনকে 'অগ্রসর হওয়ার' আহ্বান জানান। খবর বিবিসির।
ক্রেমলিন জানায়, বৈঠকটি চার ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয় এবং মূলত 'ইউক্রেন সংকট সমাধানের বিভিন্ন দিক' নিয়ে আলোচনা হয়। এটি ছিল চলতি বছরে পুতিনের সঙ্গে উইটকফের তৃতীয় বৈঠক। রুশ বিশেষ দূত কিরিল দিমিত্রিয়েভ এই আলোচনাকে 'গঠনমূলক' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ট্রাম্প এর আগেও ইউক্রেন নিয়ে আলোচনার অগ্রগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, 'রাশিয়াকে এখনই এগোতে হবে। প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে—একটি ভয়াবহ এবং অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে।'
এদিকে ট্রাম্পের ইউক্রেনবিষয়ক দূত কিথ কেলগ ইউক্রেন বিভক্ত করার প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টাইমস-এর খবরে বলা হয়, এক সাক্ষাৎকারে কেলগ পশ্চিম ইউক্রেনে 'নিরাপত্তা বাহিনী' হিসেবে ব্রিটিশ ও ফরাসি সেনা মোতায়েনের কথা বলেছিলেন। একইসঙ্গে রাশিয়ার সেনারা পূর্ব ইউক্রেনে থাকত।
পত্রিকাটির উদ্ধৃতি অনুযায়ী, কেলগ বলেছিলেন, 'আপনি একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বার্লিন ভাগ হওয়ার মতো করে দেখতে পারেন।'
তবে কেলগ পরে এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লেখেন, 'এই প্রতিবেদনে আমার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।' তিনি বলেন, 'আমি যুদ্ধবিরতির পর একটি "স্থিতিশীলতা বজায় রাখা বাহিনী" নিয়ে বলেছি যারা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করবে। আমি কখনো ইউক্রেনকে বিভক্ত করার কথা বলিনি।'
হোয়াইট হাউস ও কিয়েভ এখনো কেলগের মন্তব্যের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়নি। বিবিসি দ্য টাইমসের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য চেয়েছে।
এদিন ইউরোপীয় দেশগুলো কিয়েভকে ২ হাজার ১০০ কোটি ইউরোর (২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার) সামরিক সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা জানিয়েছেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো আভাস তারা দেখছেন না।
পুতিন-উইটকফ বৈঠকের আগে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, 'উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি আশা করার প্রয়োজন নেই', কারণ 'সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া চলছে'।
পুতিন-ট্রাম্প বৈঠকের সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে পেসকভ বলেন, 'দেখা যাক, উইটকফ কী বার্তা নিয়ে এসেছেন তার ওপর নির্ভর করছে।'
এর আগে উইটকফ সেন্ট পিটার্সবার্গের গ্র্যান্ড হোটেল ইউরোপ-এ দিমিত্রিয়েভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে রাশিয়ার বাজার ও স্টেইনলেস স্টিল নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
রাশিয়ার সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের প্রধান ৪৯ বছর বয়সী দিমিত্রিয়েভ গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন সফর করেন। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পর তিনিই যুক্তরাষ্ট্র সফর করা সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ রুশ কর্মকর্তা।
অন্যদিকে শুক্রবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নিজ শহর ক্রিভি রিহ-এ ৪ এপ্রিলের রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার স্থান পরিদর্শন করেন। ওই হামলায় ১৯ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে ৯ জনই শিশু।
জেলেনস্কি অভিযোগ করেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে রাশিয়া এখন চীনা নাগরিকদেরও ব্যবহার করছে। ইউক্রেন বলেছে, তারা দুইজন চীনা নাগরিককে আটক করেছে।
জেলেনস্কি বলেন, 'আমাদের কাছে তথ্য আছে যে, কয়েকশো চীনা নাগরিক রাশিয়ার দখলদার বাহিনীর অংশ হয়ে যুদ্ধ করছে। এর মানে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে রাশিয়া এখন চীনা প্রাণও ব্যবহার করছে।'
তিনি পরে নিহত শিশু হারমান ত্রিপোলেটস (৯), আরিনা সামোদিনা ও রাদিস্লাভ ইয়াতস্কো (উভয়েই ৭) এর ছবির সামনে ফুল দেন।
জেলেনস্কি পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান, তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, 'আমরা শুধু চাইছি না, আমরা কিনতেও প্রস্তুত।'
'আমাদের মতো প্রতিবেশী থাকলে, জীবন রক্ষা করতে পারে শুধু শক্তিশালী অস্ত্র।'
ট্রাম্প এর আগেও দাবি করেছেন, তিনি মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবেন। শুক্রবার তিনি লেখেন, ২০২২ সালে যদি তিনি প্রেসিডেন্ট থাকতেন, তাহলে এই যুদ্ধ শুরুই হতো না।
তিনি লেখেন, 'একটি যুদ্ধ যা কখনোই শুরু হওয়া উচিত ছিল না, এবং আমি প্রেসিডেন্ট থাকলে তা হতোও না!!!'
ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কর্মকর্তারা সৌদি আরবে প্রথমবারের মতো সরাসরি বৈঠক করেন। দু'দেশের মধ্যে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন নিয়েও আলোচনা চলছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির সম্পর্ক দ্বিতীয় মেয়াদে আরও টানাপড়েনপূর্ণ হয়ে ওঠে, যা শেষ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতে ওভাল অফিসে এক তীব্র বাকবিতণ্ডায় গড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে কৃষ্ণসাগরে সীমিত যুদ্ধবিরতি আনার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রাশিয়া আগ্রাসনের পর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি জানালে আলোচনায় অচলাবস্থা দেখা দেয়।
এ নিয়ে ট্রাম্প পুতিনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনি 'খুবই রাগান্বিত' ও 'মাথা গরম' অবস্থায় আছেন, কারণ এখনো কোনো যুদ্ধবিরতি হয়নি।
এই সপ্তাহের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে একটি বন্দি বিনিময়ও হয়।
রুশ-আমেরিকান নাগরিক কসেনিয়া কারেলিনা ২০২২ সালে ইউক্রেনের একটি দাতব্য সংস্থায় ৫১ ডলার অনুদান দেওয়ার দায়ে রাশিয়ায় ১২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। বৃহস্পতিবার সকালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং জার্মানি-রাশিয়ার দ্বৈত নাগরিক আর্থার পেট্রোভের সঙ্গে বিনিময় করা হয়।
পেট্রোভকে ২০২৩ সালে সাইপ্রাসে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অভিযোগ, তিনি রাশিয়ার সামরিক খাতে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ রপ্তানির কাজে জড়িত ছিলেন।