চীনের পাল্টা শুল্কে তেলের দাম ৭ শতাংশ কমে ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ নতুন মাত্রা পাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে শুক্রবার তেলের দাম এক লাফে ৭ শতাংশ কমে গেছে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীরা বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা আরও জোরালোভাবে মূল্যায়ন করছেন।
বিশ্বের শীর্ষ তেল আমদানিকারক দেশ চীন ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ১০ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যে ৩৪ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বসাবে। এর ফলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কর্তৃক শত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে শুল্ক বৃদ্ধির জবাবে অন্যান্য দেশও পাল্টা পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।
এর প্রভাব পড়েছে তেল ছাড়াও অন্যান্য পণ্যে। প্রাকৃতিক গ্যাস, সয়াবিন ও স্বর্ণের দামও নেমে গেছে। বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারগুলোতে দেখা গেছে ব্যাপক দরপতন। মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান জেপিমরগান জানিয়েছে, বছরের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ৬০ শতাংশ।
অপরিশোধিত তেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৪ ডলার ৫৬ সেন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৬৫ ডলার ৫৮ সেন্টে, যা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ পতন। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) ক্রুডের দর ৭ দশমিক ৪ শতাংশ কমে ৬১ ডলার ৯৯ সেন্টে নেমে এসেছে।
দিনের লেনদেনে ব্রেন্ট এর সর্বনিম্ন মূল্য ছিল ৬৪ ডলার ৩ সেন্ট এবং ডব্লিউটিআই পৌঁছায় ৬০ ডলার ৪৫ সেন্টে—যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
সাপ্তাহিক হিসাবে ব্রেন্টের দাম কমেছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ—এক বছরের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতন। একই সময়ে ডব্লিউটিআই-তে পতন হয়েছে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, যা দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সাপ্তাহিক ক্ষতি।
ইউনাইটেড আইক্যাপের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ স্কট শেলটন বলেন, 'আমার দৃষ্টিতে এটি এখন সম্ভবত অপরিশোধিত তেলের ন্যায্য মূল্য। তবে আমরা এখনো জানি না, আসলে চাহিদা কতটা কমেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার ধারণা, সামনের দিনগুলোতে ডব্লিউটিআই-এর দাম ৫০ ডলারের মাঝামাঝি বা তার কিছু উপরে ঘোরাফেরা করবে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে চাহিদা কমতে বাধ্য।'
ট্রাম্পের নতুন শুল্ক 'প্রত্যাশার চেয়েও বড়' উল্লেখ করে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, এর ফলে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়বে। মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনে কঠিন সিদ্ধান্তের পথ তৈরি হতে পারে।
এছাড়া, তেলের দামে আরও চাপ তৈরি করেছে ওপেক প্লাস–এর উৎপাদন বৃদ্ধির ঘোষণা। সংস্থাটি মে মাসে প্রতিদিন ৪ লাখ ১১ হাজার ব্যারেল উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেখানে আগে পরিকল্পনা ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ব্যারেল।
রাশিয়ার আদালত কাস্পিয়ান পাইপলাইন কনসোর্টিয়ামের (সিপিসি) ব্ল্যাক সি রপ্তানি টার্মিনাল বন্ধ না করার রায় দিয়েছে, যা কাজাখস্তানের তেল সরবরাহে সম্ভাব্য সংকট এড়াতে সহায়ক হবে—এটিও দাম হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতিতে তেল, গ্যাস ও পরিশোধিত জ্বালানি পণ্য ছাড় পেলেও সামগ্রিকভাবে বাজারে মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্থরতা তৈরি করতে পারে, যা তেলের চাহিদা ও দামে প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাচস তাদের পূর্বাভাসে ব্রেন্ট ও ডব্লিউটিআই তেলের ডিসেম্বর ২০২৫ সালের লক্ষ্যমূল্য ব্যারেলপ্রতি ৫ ডলার কমিয়ে যথাক্রমে ৬৬ ও ৬২ ডলারে নামিয়ে এনেছে। ব্যাংকের তেল গবেষণা প্রধান ডান স্ট্রুভেন এক নোটে বলেন, 'আমাদের হ্রাসকৃত মূল্যপ্রত্যাশার ঝুঁকি নিচের দিকেই বেশি, বিশেষ করে ২০২৬ সালের ক্ষেত্রে। এর কারণ হলো—মন্দার আশঙ্কা এবং তুলনামূলকভাবে বেশি ওপেক প্লাস সরবরাহ।'
এইচএসবিসিও ২০২৫ সালের বৈশ্বিক তেলের চাহিদা বৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ১০ লাখ ব্যারেল থেকে ৯ লাখ ব্যারেলে নামিয়ে এনেছে। তাদের মতে, শুল্ক আরোপ এবং ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তই এর মূল কারণ।
এদিকে, মার্কিন পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিশন (সিএফটিসি) জানায়, ১ এপ্রিল পর্যন্ত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেল সংক্রান্ত ফিউচার ও অপশন লেনদেনে তাদের নিট লং পজিশন আরও বাড়িয়েছে।