মিয়ানমারে ভূমিকম্প: মান্দালয় যেন ধ্বংসস্তূপ, খালি হাতেই চলছে আটকে পড়াদের উদ্ধারের চেষ্টা

মিয়ানমারে গতকাল শুক্রবার শক্তিশালী ভূমিকম্পে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। এদিন দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার আট দেশে অনুভূত হয় এ ভূমিকম্প। যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মিয়ানমারেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, গতকাল স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল মিয়ানমারের দ্বিতীয় বড় শহর মান্দালয় থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। ভূমিকম্পের ১২ মিনিট পর ৬ দশমিক ৪ মাত্রার একটি পরাঘাত (আফটার শক) অনুভূত হয়।
ফলে দেশটিতে দুর্যোগ পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। উদ্ধারকাজে দরকারি যন্ত্র ও সরকারি তৎপরতার অভাবে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন ভবনের নিচে আটকা পড়ে রয়েছে বহু মানুষ।
হতে মিন-ওহ নামের এক যুবকের বর্ণনাতেও তা উঠে এসেছে। বছর ২৫ এর এই যুবকের গায়ের ওপর ইটের একটি দেয়াল ধসে পড়ে, এতে চাপা পড়ে তাঁর শরীরের নিচের অর্ধেক। সেখান থেকে উদ্ধার হয়ে তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের উদ্ধার করতে যান। বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে তিনি জানান, তাঁর দাদী ও দুই চাচা বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকা পড়েছেন। তিনি খালি হাতে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে তাদের বের করে আনার চেষ্টাও করেন। কিন্তু, পারেননি শেষপর্যন্ত।
সেখানে অনেক বেশি ধ্বংসস্তূপ, আমাদের উদ্ধার করতে কেউ আসেনি'- বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
ভূমিকম্পের পরপরই স্থানীয়রা ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়াদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। কিন্তু, খালি হাতেই দুর্গতদের জীবনরক্ষার এই লড়াই করতে হচ্ছে তাঁদের।
ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ভেসে আসছে আটকে পড়া মানুষের অসহায় আর্ত-চিৎকার। উদ্ধারকারীরা খালি হাতেই ইটপাথরের স্তূপের মধ্যে থেকে মানুষকে টেনে বের করে আনতে চাইছেন, যা বেশিরভাগক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।
উদ্ধারকাজে সরকারি সংস্থাগুলোর কর্মীদের উপস্থিতি সেভাবে নেই। মিয়ানমার শাসন করছে নিষ্ঠুর এক সামরিক জান্তা, যারা ২০২১ সালের এক সামরিক ক্যু'র মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। এরপরে গৃহযুদ্ধ পতিত হয় দেশটি। তখন থেকেই সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে আরও অনেক নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছে সরকারি বাহিনীগুলো
মিয়ানমারের জান্তা সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, ভূমিকম্পে সড়ক, সেতু ও ভবনের মতো অবকাঠামোগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে বেসামরিক নাগরিকরা হতাহত হয়েছে।
শুক্রবার মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
এদিকে শুক্রবারেই আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলো জানায়, ভয়াল এই ভুমিকম্পে এক হাজার জন নিহত হয়েছেন। তবে তা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মান্দালয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়া একজন বলেছেন, 'এটা যেন এখন ধ্বংসের নগরী। কেউ কেউ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছেন। এটা খুবই মারাত্মক ছিল। এতটাই মারাত্মক, আমি আগে কখনো এমন ঝাঁকুনি হতে দেখিনি।'
গৃহযুদ্ধে মিয়ানমারের জরুরী সেবা ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক অবকাঠামোও ধ্বংস হয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মিয়ানমারের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর শিলা ম্যাথিউ বলেন, 'সবচেয়ে বাজে সময়ে শক্তিশালী এই ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে দেশটিতে। আরেকটি দুর্যোগের ভার বইতে পারবে না মিয়ানমার।'
ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির মিয়ানমার-বিষয়ক পরিচালক মোহাম্মদ রিয়াস বলেন, ব্যাপক সহিংসতায় আক্রান্ত হয়েছেন দেশটির নাগরিকরা। সংঘাতে ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্য খাত। বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে কলেরাসহ অন্যান্য রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব।
তিনি বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, ভুমিকম্পে যারা আহত হয়েছেন— তাঁদের চিকিৎসা সেবা দিতে এরমধ্যেই নাজুক হয়ে পড়া স্বাস্থ্যখাত আরও চাপের মুখে পড়বে।
এবিষয়ে মন্তব্যের জন্য মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে রয়টার্স যোগাযোগ করলেও, তারা এতে সাড়া দেয়নি।
তবে মিয়ানমারের মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী বিদ্রোহীদের জাতীয় ঐক্যের সরকার টেলিফোনে রয়টার্সকে জানিয়েছে, উদ্ধার তৎপরতায় সাহায্যের জন্য তাঁরা জান্তা-বিরোধী যোদ্ধাদের মোতায়েন করবে।