মিয়ানমারের জান্তাকে বিধ্বস্ত করার চাবিকাঠি আরাকান আর্মির হাতে!

শুস্ক মৌসুমের খরতাপে দগ্ধ মিয়ানমার, আসন্ন বর্ষায় যোগাযোগ আরও দুরূহ হওয়ার আগে— শুস্ক মৌসুমেই সংঘাত তীব্রতর হয়। বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী আরাকান আর্মি-ও বর্ষার আগে বড় জয়ের জন্য লড়ছে। কিন্তু কী তাঁদের কৌশলগত লক্ষ্য? জাতিগত এই বিদ্রোহীরাই কী হবে মিয়ানমারের কিং মেকার?
সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে, এপর্যন্ত আরাকান আর্মির অর্জিত সাফল্যের দিকে তাকানো দরকার।
মিয়ানমারের পশ্চিম সমুদ্র উপকূলের প্রদেশ রাখাইন। এক বছরের বেশি সময়ের প্রচণ্ড লড়াইয়ে, এই প্রদেশের অধিকাংশ অঞ্চলের ওপরই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে আরাকান আর্মি। রাখাইন জাতির বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি মিয়ানমারের অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর চেয়ে অনেকটাই আলাদা, কারণ অঞ্চলভিত্তিক বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে একেক সম্প্রদায়ের হাতে। অন্যদিকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বামারদের নিয়ে গঠিত হয়েছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সেনাশাসন উৎখাতে যারা এখন আঞ্চলিক বিদ্রোহীদের গ্রুপগুলোর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জান্তা সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি) নামের এই সামরিক সরকারের বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা সবাই একাট্টা।
তবু কিছু বিশেষ সুবিধায় এগিয়ে আছে আরাকান আর্মি। রাখাইনের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে তারা বড় সুবিধা পায়। সামরিক শক্তিও তাদের উল্লেখযোগ্য। দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর শক্ত আঁটুনিতে ধরা পড়ে না। দেশি ও বিদেশি সহযোগিতাও পায়।
ফলে ৩০ হাজারের বেশি নিয়মিত যোদ্ধার এক সংগঠিত ও যুদ্ধাভিজ্ঞ বাহিনী তারা গড়ে তুলতে পেরেছে। যাদের নেতৃত্বে রয়েছেন ৪৭ বছরের রাখাইন জাতীয়তাবাদী তুয়ান ম্রাত নিয়াং। যিনি একজন ক্যারিশমাটিক সেনানায়ক-ও। তাঁর নেতৃত্বে আরাকান আর্মি পারে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের চূড়ান্ত ফয়সালায় ভূমিকা রাখতে, যে যুদ্ধ এপর্যন্ত ৩০ লাখের বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, দেশটিকে করেছে বিভক্ত।
যুদ্ধের শেষ দুই ফ্রন্ট
২০২৩ সালের নভেম্বরে কোকাং ও তাং জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের সঙ্গে একযোগে এক আক্রমণ অভিযানে নামে আরাকান আর্মি। এই অভিযানের মাধ্যমে রাখাইন রাজ্য থেকে জান্তা সেনাদের প্রায় পুরোপুরি তাড়িয়ে দিয়েছে তারা।
তবে এখনও দুটি ফ্রন্টে তাদেরকে লড়তে হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে, প্রাদেশিক রাজধানী সিতওয়ের নিকটে, এবং ১১০ কিলোমিটার দক্ষিণে কিয়োকফিউ শহরের দখল নিতে— যেখানে নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটিসহ চীনের তৈরি গভীর সমুদ্রবন্দর এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। এখান থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন চলে গেছে উত্তরদিকে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত।
সাগর উপকূলের অভিযানে ঝুঁকি
মে মাসের মৌসুমি বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই, সিতওয়ে ও কিয়োকফিউ দখল করতে হবে আরাকান আর্মিকে। তার মধ্যে দিয়েই সম্ভব হবে সম্পূর্ণ রাখাইনকে স্বাধীন করার ঐতিহাসিক অর্জন। এজন্য বড় অভিযানে যেতে হবে তাদের।একইসঙ্গে পূবদিকেও মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে।
আরাকান আর্মির হাতে প্রাদেশিক রাজধানীর পতন হলে– জান্তা বাহিনীর জন্য তা হবে মারণ আঘাত। একইসঙ্গে আরাকান আর্মির জন্য এ বিজয়ের প্রতীকী ও রাজনৈতিক গুরুত্বও হবে অপরিসীম। যা তাদের মনোবল চাঙ্গা করবে বহুগুণ। নবউত্থান ঘটবে রাখাইন জাতীয়তাবাদের।
অন্যদিকে কিয়োকফিউ দখলে নিলে সমুদ্রের তেল ও গ্যাস উত্তোলন থেকে অর্থ আয়ের সুযোগ হারাবে জান্তা সরকার। যার বড় প্রভাব পড়বে তাদের যুদ্ধ প্রচেষ্টায়।
তবে এই দুই বন্দর নগরীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে যথেষ্ট শক্তিশালী, এবং সেখানে হাজার হাজার জান্তা সেনা মোতায়েন রয়েছে। ফলে এই দখলাভিযানের ঝুঁকিও ব্যাপক। আরাকান আর্মির তীব্র আক্রমণের মুখে সেনা জল ও আকাশপথে রসদ সরবরাহের সুবিধাও পাবে জান্তা সরকার। মিয়ানমারের নৌবাহিনীও সমুদ্রপথে আরাকান আর্মির ওপর হামলা করতে পারবে। আর আকাশপথে যুদ্ধবিমান থেকেও প্রচণ্ড আঘাত হানবে।
তবে গতবছরেও বেশকিছু উপকূলীয় শহর, যেমন নগাপালি, মুয়াংডো এবং মুয়াং শুয়ে-লে নৌঘাঁটি দখল করতে পেরেছিল আরাকান আর্মি, এতে ইঙ্গিত মেলে যে শেষপর্যন্ত তারা হয়তো সফলও হবে।
তবে এই লড়াই হবে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী, এতে বিপুল গোলাবারুদ ক্ষয় হবে, এবং কৌশলগত মজুতেও টান পড়বে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, হাজার হাজার যোদ্ধা নিহত হতে পারে আরাকান আর্মির, আহতের সংখ্যা ১০ হাজার পর্যন্তও হতে পারে।
২০২৩ সাল থেকে লড়াইয়ে এরমধ্যে অসংখ্য যোদ্ধা হারিয়েছে আরাকান আর্মি, সে অবস্থায় আরও বিপুল প্রাণহানি হয়তো তারা এড়াতেই চাইবে।
তাছাড়া সর্বগ্রাসী যুদ্ধের আগুনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে এসব শহর, বন্দর। ফলে জিততে পারলেও ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই তারা পাবে না। গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অবকাঠামোও ধ্বংস হবে, রাখাইনের ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনের জন্য যার প্রয়োজন আছে।
@তাহলে বিকল্প কী?
তুয়ান ম্রাত নিয়াং ও তাঁর সামরিক উপদেষ্টারা নিশ্চিতভাবেই বিকল্প হিসেবে আরাকান ইয়োমা পর্বতাঞ্চলে যুদ্ধের পরিকল্পনা করবেন। কারণ এখানে জান্তা বাহিনীকে পরাজিত করা গেলে, নিচের দিকের শিল্প ও কৃষি অঞ্চলে অগ্রসর হওয়া যাবে ইরাবতী নদীর সমভূমি ও বদ্বীপ অঞ্চলে। এখানেই রয়েছে জান্তা সরকারের প্রাণভোমরা।
কারণ পিডিএফ-সহ অন্যান্য বিদ্রোহীরাও এখানে সক্রিয়। আরাকান আর্মির সমর্থনে তারা প্রচণ্ড আঘাত হানতে পারবে জান্তার শক্তিকেন্দ্রগুলোতে। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে পুরোদমে লড়াই শুরু হলে— জান্তা সরকারের আয়ের উপায় প্রায় বন্ধের উপক্রম হবে। তখন সামরিক অভিযানের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
আরাকান আর্মি এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ হাবগুলোকেও বিচ্ছিন্ন করতে পারবে তখন। ফলে জান্তা বাহিনীর চলাচলও কঠিন হয়ে পড়বে। আবার তারা যদি শত্রু বাহিনীর পেছন দিকের সড়কগুলোতে প্রতিবন্ধকতা ও চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে পারে, তাহলে মোটামুটি বিপর্যস্তই হয়ে পড়বে সামরিক জান্তা। তখন কোনদিক থেকে আক্রমণ আসছে, আর সেখানে কোন ধরনের শক্তিপ্রয়োগ করতে হবে– তা বুঝে ওঠার আগেই আঘাতে আঘাতে দিশেহারা হয়ে পড়বে।
পূর্ব রণাঙ্গনে চিন ও বামারদের নেতৃত্বাধীন পিডিএফের সহযোগিতাও নিতে পারবে আরাকান আর্মি। মিয়ানমারের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সশস্ত্র শক্তি হিসেবে তারা যদি আরাকান আর্মির কম্যান্ডের অধীনে আসে, তাহলে পাল্টে যাবে পাশার দান। জান্তা সরকারের চরম কোণঠাসা হয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে খোদ বামার ভূমির কেন্দ্রীয় অঞ্চলেই।
তাদের সম্মিলিত আক্রমণ দুদিক থেকে ফাটল ধরাতে পারবে জান্তা বাহিনীর প্রতিরক্ষায়। তখন শুধু পতনের অপেক্ষায় থাকবে রাজধানী নেপিডো।
এর কোনোটাই সহজ না হলেও— আরাকান আর্মি তার পূর্বদিকের অভিযানে পরিকল্পনামতো এগোতে পারলে, জান্তার কোমর ভাঙার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। আর সেটাই হবে মিয়ানমারের ঐতিহাসিক ফয়সালার মুহূর্ত।