ইউক্রেন শান্তি চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি ট্রাম্পের

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুক্রবার রাশিয়ার ওপর বড় ধরনের মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। এর কয়েক দিন আগে তিনি ইউক্রেনে সব ধরনের সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা সহায়তা স্থগিত করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি উভয় দেশকে শান্তি চুক্তির আলোচনায় এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ট্রাম্পের ব্যাংকিং বিধিনিষেধ ও শুল্ক আরোপের হুমকি আসে সোমবার রয়টার্সের এক প্রতিবেদনের পর, যেখানে জানানো হয়েছিল, হোয়াইট হাউজ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে এবং মস্কোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রাশিয়াকে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা থেকে কিছুটা অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মে বলেছেন, 'রাশিয়া বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনকে সম্পূর্ণভাবে আঘাত করছে। এই বাস্তবতার ভিত্তিতে আমি রাশিয়ার ওপর বড় আকারের ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞা, অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা এবং শুল্ক আরোপের কথা দৃঢ়ভাবে বিবেচনা করছি– যতক্ষণ না যুদ্ধবিরতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত সমঝোতা চুক্তি সম্পন্ন হয়।'
তিনি আরও বলেছেন, 'রাশিয়া এবং ইউক্রেন, এখনই আলোচনার টেবিলে বসুন, দেরি হওয়ার আগে। ধন্যবাদ!!!'
গত গ্রীষ্মে রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে আকস্মিক আক্রমণ চালানো হাজারো ইউক্রেনীয় সেনাকে রুশ সেনারা ঘিরে ফেলেছে। কিয়েভ আশা করেছিল, এই অভিযান মস্কোর সঙ্গে যে কোনো শান্তি আলোচনায় তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে।
তবে জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই কিয়েভের প্রতি সমালোচনামূলক মনোভাব দেখিয়ে মস্কোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছেন ট্রাম্প। দিন শেষে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্পর্কে আরও আপসমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন পুতিন শান্তি চান।
ট্রাম্প বলেন, 'আমি মনে করি তিনি (পুতিন) যুদ্ধ বন্ধ করে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে চান এবং আমি মনে করি, তিনি এখন আগের চেয়ে আরও শক্তভাবে আঘাত করছেন। যে কেউ এমন পরিস্থিতিতে থাকলে সম্ভবত একই কাজ করতেন।'
তিনি আরও বলেন, 'সত্যি বলতে, ইউক্রেনের সঙ্গে সমঝোতা করা আমার জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠছে।'
ওপেন সোর্স মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের অবস্থান গত তিন দিনে মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। রুশ পালটা আক্রমণ প্রায় ইউক্রেনীয় বাহিনীকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে এবং প্রধান সরবরাহ লাইন থেকে মূল দলটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
ফিনল্যান্ডভিত্তিক ব্ল্যাক বার্ড গ্রুপের সামরিক বিশ্লেষক পাসি পারোইনেন রয়টার্সকে বলেছেন, 'কুরস্কে ইউক্রেনের পরিস্থিতি খুবই খারাপ।'
যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান স্থগিত করার পর রাশিয়া প্রথমবারের মতো বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইউক্রেনের জ্বালানি ও গ্যাস অবকাঠামোর ক্ষতি করেছে।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই হামলায় এক শিশুসহ ১০ জন আহত হয়েছে।
শান্তির আহ্বান
মস্কোর প্রতি মার্কিন কূটনীতির মনোভাব পরিবর্তনের ইঙ্গিতের পর পশ্চিমা সমর্থন ধরে রাখতে সচেষ্ট ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আকাশ ও সমুদ্রজুড়ে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
জেলেনস্কি টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপে বলেছেন, 'বাস্তব শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত এই যুদ্ধের একমাত্র উৎস রাশিয়াকে এ ধরনের হামলা বন্ধ করতে বাধ্য করা।'
ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রস্তাবিত এই সাময়িক যুদ্ধবিরতির ধারণা মস্কো প্রত্যাখ্যান করেছে। একই সঙ্গে তারা স্পষ্ট জানিয়েছে, ন্যাটো সদস্য দেশের শান্তিরক্ষীরা ইউক্রেনে প্রবেশ করতে পারবে না। যদিও ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইউরোপীয় বাহিনীর মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমঝোতা বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল উৎপাদক দেশ রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় রাশিয়ার তেল ও গ্যাস খাতও রয়েছে, যেখানে রাশিয়ার তেল রপ্তানির জন্য ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। দুটি নির্ভরযোগ্য সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে মস্কো সম্মত হলে রুশ জ্বালানি খাতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার সম্ভাব্য উপায় খতিয়ে দেখবে যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্প রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলেননি।
ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও জেলেনস্কি বৃহস্পতিবার রাতে জানিয়েছেন, তিনি আগামী সোমবার সৌদি আরবে যাবেন এবং সেখানে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করবেন। পরে সপ্তাহের শেষে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনাও হবে।
ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ইতোমধ্যে রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি চুক্তির একটি কাঠামো নিয়ে আলোচনা চলছে এবং আগামী সপ্তাহে সৌদি আরবে ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে।
রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে, যার মধ্যে ২০১৪ সালে রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়া অঞ্চলও রয়েছে। বর্তমানে রুশ সেনারা পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্ক অঞ্চলে ধীর কিন্তু ধারাবাহিক অগ্রগতি অর্জন করছে।
কিয়েভ যে কোনো শান্তি চুক্তির জন্য শক্তিশালী নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দাবি জানিয়ে আসছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ট্রাম্প বলেছেন, একটি সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ চুক্তি এই নিশ্চয়তার জন্য যথেষ্ট হবে। তবে জেলেনস্কি এখনো সেই খনিজ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেননি এবং এক সপ্তাহ আগে প্রকাশ্যে ট্রাম্পের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছিলেন।
হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ জানিয়েছেন, তিনি এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সৌদি আরবে ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেবেন এবং তাদের আশা এই আলোচনা সম্পর্ক উন্নত করবে।
ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা শুক্রবার রুবিওর সঙ্গে একটি 'গঠনমূলক আলোচনা' করেছেন।