মার্কিন সামরিক সহায়তা স্থগিত ইউক্রেনের জন্য কত বড় আঘাত?

ওয়াশিংটনের সামরিক সহায়তা স্থগিতের ফলে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হঠাৎ ভেঙে পড়বে না। তবে আসন্ন কয়েক মাসে যুদ্ধক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে দেশটির বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও নিখুঁত হামলার সক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
রয়টার্সকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) স্থানীয় সময় রাত ৩টা ৩০ মিনিটে ইউক্রেনের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গত সপ্তাহে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সহায়তা স্থগিত করেন।
এতে কংগ্রেস অনুমোদিত ৩.৮৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার অবশিষ্ট অংশ বরাদ্দ আটকে যায়। পাশাপাশি, বাইডেন প্রশাসন অনুমোদিত সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহও বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কার্নেগি এনডাউমেন্টের জ্যেষ্ঠ গবেষক মাইকেল কফম্যান বলেন, 'যদি যুদ্ধের শুরুর দিকে এই সহায়তা স্থগিত হতো, তবে এর প্রভাব আরও ব্যাপক হতে পারত। তবে এখন ইউক্রেন আগের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার ওপর কম নির্ভরশীল।'
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, 'এটি ইউক্রেনকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে। কয়েক মাস পর সরঞ্জামের মজুদ কমে গেলে এর প্রভাব আরও প্রকট হয়ে উঠবে।'
বিশেষ করে, উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করা ইউক্রেনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা রাশিয়ার নিয়মিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করতে ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া, ৭০-৮৫ কিলোমিটার পাল্লার এইচআইএমএআরএস (হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম) ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হলেও চাপে পড়বে ইউক্রেন। কারণ এটি ইউক্রেনীয় বাহিনীর অন্যতম প্রধান অস্ত্র।
২০২২ সালে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল। তবে ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে রিপাবলিকানদের আপত্তির কারণে সহায়তা বিলম্বিত হলেও দেশটি প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এই বিলম্বের ফলে ফ্রন্টলাইনে ইউক্রেনীয় সেনারা গোলাবারুদের সংকটে পড়ে। ফলে রুশ বাহিনী অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পায়।
তবে এবার গোলাবারুদের ঘাটতির প্রভাব আগের মতো গুরুতর হবে না। ইউরোপ এখন উল্লেখযোগ্য হারে গোলাবারুদের সরবরাহ বাড়িয়েছে এবং অন্যান্য দেশও সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সহায়তা দিচ্ছে।
বর্তমানে ইউক্রেন বেশিরভাগ হামলার জন্য নিজস্ব উৎপাদিত ড্রোন ব্যবহার করছে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, 'যুদ্ধক্ষেত্রে আর্টিলারি এখনও গুরুত্বপূর্ণ। তবে যুদ্ধের ধরন বদলে গেছে এবং এখন এটি মূলত ড্রোনভিত্তিক হয়ে উঠেছে।'
ইউক্রেনের সংসদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কমিটির সচিব রোমান কস্তেঙ্কো বলেন, '২০২৪ সালে ইউক্রেনের হামলায় নিহত বা আহত ৬৫ শতাংশ রুশ সেনা ড্রোন হামলার শিকার হয়েছেন, যেখানে ২০ শতাংশ আর্টিলারি হামলার কারণে এবং মাত্র ১০ শতাংশ মার্কিন গোলাবারুদের কারণে মারা গেছেন।'
তবে ১৫৫ মি.মি. আর্টিলারি শেলের ঘাটতি ইউক্রেনের জন্য একটি সমস্যা তৈরি করতে পারে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র ছিল এর প্রধান সরবরাহকারী। কস্তেঙ্কোর মতে, বর্তমান যুদ্ধের তীব্রতা বজায় থাকলে মজুদকৃত অস্ত্র দিয়ে সম্ভবত গ্রীষ্মের মাঝামাঝি পর্যন্ত যুদ্ধ চালানো সম্ভব হবে।
ইউক্রেনের সংসদ সদস্য সেরহি রাখমানিন বলেন, এখন প্রধান প্রশ্ন হলো— যুক্তরাষ্ট্র কি তৃতীয় পক্ষের দেশগুলোকে ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করতে বাধা দেবে? এসব দেশ মার্কিন উৎপাদন লাইসেন্সধারী হলেও তারা অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কিয়েল ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ৬৪ বিলিয়ন ইউরোর বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছে, যেখানে ইউরোপের সহায়তা প্রায় ৬২ বিলিয়ন ইউরো।
রাখমানিনের মতে, ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্রদের যদি যথেষ্ট স্বাধীনতা, সময়, ইচ্ছা, অর্থ এবং সামর্থ্য থাকে, তবে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে।
এছাড়া, মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় অব্যাহত থাকবে কি না, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের সহযোগিতা বন্ধের কোনো ইঙ্গিত মেলেনি। তবে যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে কিয়েভের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে ওয়াশিংটন।
থিংক-ট্যাংক ইউরোইন্টেলিজেন্স বলেছে, 'এটি যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার প্রথম ধাপ মাত্র, যেমন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনও ধাপে ধাপে হবে।'
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, 'এই সিদ্ধান্ত এককভাবে যুদ্ধের গতিপথ বদলাবে না। তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বার্তা বহন করছে।'