কেন জেলেনস্কির প্রতি এত আগ্রাসী হলেন ভ্যান্স?

শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে। খবর বিবিসির।
জেলেনস্কিকে বেশ কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেন জেডি ভ্যান্স, বৈঠকে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের চিরাচরিত রীতিকে উপেক্ষা করে সরাসরি তীব্র সমালোচনায় যান। এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে কেবল ট্রাম্পের ছায়াসঙ্গী নয়, বরং তার নীতি ও আদর্শের শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হিসেবেই তুলে ধরলেন বলা চলে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উপস্থিত থাকলেও, মূলত ভ্যান্সই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বৈঠকের শুরুতে উভয় নেতা কূটনৈতিক সৌজন্য বজায় রাখলেও, ভ্যান্স যখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের 'কূটনৈতিক সমাধান' খোঁজার জন্য ট্রাম্পের প্রশংসা করেন, তখনই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে।
এ সময় জেলেনস্কি প্রশ্ন তোলেন, 'কোন ধরনের কূটনীতি আপনি বলছেন, জেডি? এর অর্থ কী?'
জবাবে ভ্যান্স স্পষ্টভাবে বলেন, 'আমি এমন কূটনীতির কথা বলছি যা আপনার দেশের ধ্বংস বন্ধ করবে।' এরপর তিনি কড়া ভাষায় ইউক্রেনীয় নেতাকে বলেন, 'জনাব প্রেসিডেন্ট, যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, ওভাল অফিসে এসে আমেরিকান গণমাধ্যমের সামনে এই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করাটা আপনার জন্য শোভনীয় নয়।'
এছাড়া, ভ্যান্স ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে গণতান্ত্রিক দলের পক্ষ নিয়ে প্রচার চালানোর অভিযোগও তোলেন জেলেনস্কির বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে পেনসিলভানিয়ার একটি অস্ত্র কারখানা পরিদর্শন এবং ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বৈঠক করার মাধ্যমে জেলেনস্কি রাজনৈতিক পক্ষপাত দেখিয়েছেন।
ভ্যান্সের এই কঠোর অবস্থানের পর রিপাবলিকানদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন দেখা যায়।
দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতিশীল দক্ষিণ ক্যারোলিনার সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেন, 'জেডি ভ্যান্সকে আমাদের দেশের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে দেখে আমি গর্বিত।' তিনি আরও বলেন, জেলেনস্কির উচিত পদত্যাগ করা।
অন্যদিকে, আলাবামার সিনেটর টমি টিউবারভিল জেলেনস্কিকে 'ইউক্রেনীয় কৌশলী শিয়াল' বলে আখ্যা দেন।
তবে নিউইয়র্কের কংগ্রেসম্যান মাইক ললার কিছুটা সংযত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বৈঠকটিকে 'যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন উভয়ের জন্যই একটি হারানো সুযোগ' হিসেবে বর্ণনা করেন।
মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এমন তীব্র কূটনৈতিক মনোভাব বিরল। সাধারণত তাদের ভূমিকা থাকে রাষ্ট্রপতির বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে থাকা এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা। মাইক পেন্সের মতো সংযত ও শান্ত ভাইস-প্রেসিডেন্টদের তুলনায় ভ্যান্স সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন।
ভ্যান্সের ইউক্রেন ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নতুন নয়। ২০২২ সালে সিনেট নির্বাচনের সময় তিনি বলেছিলেন, 'আমি সত্যি বলতে ইউক্রেনের ভাগ্য নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না।' তবে, এক সময় ট্রাম্পকে 'বোকা' বলা ভ্যান্স এখন তার অন্যতম আস্থাভাজন ও মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন ক্যাম্পেইনের অগ্রবর্তী মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। যদিও ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, ২০২৮ সালের নির্বাচনে ভ্যান্স তার উত্তরসূরি হবেন কি না, তা বলা এখনই সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক মহলে বিশ্লেষকদের মতে, ভ্যান্স নিজেকে ট্রাম্পের 'রাজনৈতিক যোদ্ধা' হিসেবে গড়ে তুলছেন, যিনি রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক ইস্যুতে আরও আক্রমণাত্মক অবস্থান নিচ্ছেন।
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে তিনি ইউরোপীয় নেতাদের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, 'আপনারা যদি নিজ জনগণের প্রতিক্রিয়ায় আতঙ্কিত থাকেন, তাহলে আমেরিকা আপনাদের সাহায্য করতে পারবে না।' তার এই বক্তব্য ইউরোপীয় কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
এছাড়া, তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মারের সঙ্গেও বাকযুদ্ধে জড়ান। ভ্যান্স অভিযোগ করেন, 'যুক্তরাজ্যে বাকস্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে, যা মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।' জবাবে স্টার্মার বলেন, 'যুক্তরাজ্যে বাকস্বাধীনতার গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে এবং তা ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে।'
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে প্রশ্ন—ভ্যান্স কি ট্রাম্পের নির্দেশেই এই ভূমিকা নিচ্ছেন, নাকি নিজেকে ২০২৮ সালের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করছেন? যা-ই হোক, এটি স্পষ্ট যে, ভ্যান্স কেবল ট্রাম্পের দ্বিতীয় ব্যক্তি নন, বরং নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন।