সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া আলোচনার টেবিলে কারা ছিলেন?

সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া আলোচনা মস্কোর দীর্ঘদিনের পশ্চিমা বিচ্ছিন্নতা অবসানের ইঙ্গিত হতে পারে। তিনজন মার্কিন প্রতিনিধি ও দুইজন রুশ প্রতিনিধি এই আলোচনায় অংশ নেন। খবর বিবিসি'র।
উভয় দেশই এটিকে বৃহত্তর 'উচ্চ পর্যায়ের' আলোচনার ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে নিজ নিজ দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনে একমত হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এ আলোচনার অন্যতম মার্কিন প্রতিনিধি ছিলেন। তিন দিন আগেই রাশিয়ার অভিজ্ঞ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তিনি। মঙ্গলবারের বৈঠকের পর তিনি জানান, তিনি নিশ্চিত যে রাশিয়া যুদ্ধ শেষ করার জন্য একটি 'গুরুতর প্রক্রিয়ায়' আগ্রহী এবং দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় শুরু করবে।
রুবিও দীর্ঘদিন ধরেই ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান চেয়েছেন এবং ২০২৪ সালে ৬ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন সামরিক সহায়তা প্যাকেজের বিপক্ষে ভোট দেন। তিনি চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন, বেইজিং চাইছে যুক্তরাষ্ট্র যেন ইউরোপে 'অবরুদ্ধ' হয়ে থাকে।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, 'একটি বৈঠক যুদ্ধ শেষ করতে পারবে না।' তিনি জানান, ইউক্রেন ও ইউরোপকেও এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। 'এখানে কেউ উপেক্ষিত হচ্ছে না।'
এই বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ। তিনি আলোচনার পর বলেন, তারা যুদ্ধের সাময়িক নয়, স্থায়ী সমাধানের জন্য কাজ করছেন। তবে গত সপ্তাহের শেষে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনে বিলিয়ন ডলার খরচ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র 'কোনো না কোনো ধরনের প্রতিদান' পাওয়ার যোগ্য।
বৈঠকে উপস্থিত তৃতীয় মার্কিন প্রতিনিধি ছিলেন স্টিভ উইটকফ। মাত্র এক সপ্তাহ আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পই তাকে মস্কোয় পাঠিয়েছিলেন ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনার জন্য।
তাত্ত্বিকভাবে তিনি ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত। তাকে ট্রাম্পের বিশ্বস্ত ও পছন্দের আলোচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধবিরতির আলোচনায় যুক্ত ছিলেন এবং পরে তাকে রাশিয়ায় পাঠানো হয় মার্কিন বন্দি মার্ক ফোগেল ও যুক্তরাষ্ট্রে আটক রুশ নাগরিক আলেকজান্ডার ভিনিকের বিনিময় আলোচনার জন্য।

রাশিয়া এই প্রাথমিক মতবিনিময়ের জন্য দুই শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিককে বেছে নিয়েছে। দুজনই অভিজ্ঞ এবং যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। তারা হলেন— প্রেসিডেন্ট পুতিনের পররাষ্ট্রনীতি উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ এবং ২০০৪ সাল থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা সের্গেই লাভরভ।
তারা তিন বছর ধরে চলমান যুদ্ধের সময় পুতিনকে পররাষ্ট্রনীতিতে পথ দেখিয়েছেন এবং মস্কোর বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব মূলত লাভরভের ওপরই ছিল। মঙ্গলবারও তিনি সেটিই করেছেন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল যখন জ্বালানি স্থাপনায় হামলা বন্ধের প্রস্তাব দেয়, তখন লাভরভ দাবি করেন, রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনের বেসামরিক জ্বালানি সরবরাহকে লক্ষ্যবস্তু করেনি। অথচ বাস্তবতা হলো, রুশ বাহিনীর জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে একের পর এক হামলার কারণে ইউক্রেনে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরুর পরপরই ব্যর্থ যুদ্ধবিরতি আলোচনায় অংশ নিয়ে লাভরভ দাবি করেছিলেন, রাশিয়া কোনো আগ্রাসন চালায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ার সাবেক রাষ্ট্রদূত হিসেবে ৭৭ বছর বয়সী ইউরি উশাকভ জানেন কীভাবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে কথা বলতে হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে ফেরার কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি ইঙ্গিত দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র 'প্রাসঙ্গিক সংকেত' পাঠালে রাশিয়া আলোচনায় প্রস্তুত। ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের কয়েকদিন আগে তিনি বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে 'চরম আতঙ্ক' ছড়ানোর অভিযোগ আনেন, যখন ওয়াশিংটন সতর্ক করেছিল যে রুশ সেনারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

একজন তৃতীয় রুশ প্রতিনিধি আলোচনার ঘরে না থাকলেও কিরিল দিমিত্রিয়েভের উপস্থিতি প্রমাণ করে, সৌদি আলোচনার অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ভ্লাদিমির পুতিন কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।
৪৯ বছর বয়সী দিমিত্রিয়েভ রাশিয়ার ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের প্রধান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তার লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। তিনি আরো বলেন, 'আমাদের যৌথ প্রকল্প নেওয়া দরকার, যেমন আর্কটিক অঞ্চলসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে।'
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দিমিত্রিয়েভ মার্কিন বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়ায় স্টিভ উইটকফের সঙ্গে কাজ করেছেন। এর ওপর নির্ভর করেই ট্রাম্প ও পুতিনের সাম্প্রতিক ফোনালাপের ভিত্তি তৈরি হয়। এতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানও জড়িত ছিলেন।

দিমিত্রিয়েভের সঙ্গে পুতিনের পারিবারিক সম্পর্কও রয়েছে। এছাড়া, রাশিয়ার খুব কম মানুষই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও ব্যবসা খাত সম্পর্কে দিমিত্রিয়েভের মতো জানেন। তিনি একসময় গোল্ডম্যান স্যাকসের বিনিয়োগ ব্যাংকার ছিলেন এবং হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন।
যদিও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, রাশিয়ার অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে, বাস্তবতা হলো দেশের ৪৩ শতাংশ বাজেট যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় ব্যয় হচ্ছে। এছাড়া, মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশে পৌঁছেছে এবং সুদের হার বেড়ে ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
সৌদি আরবের দুই আয়োজক বৈঠকের সূচনা পর্বের সভাপতিত্ব করলেও পরে কক্ষ ত্যাগ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান এ বছর শীর্ষ সৌদি কূটনীতিক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি লেবানন ও ইউরোপ সফর করেছেন এবং সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক বৈঠকের আয়োজন করেছেন।

সৌদি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসায়েদ আল-আইবানও সিরিয়ার নতুন নেতা আহমেদ আল-শারার সঙ্গে সম্পর্ক সুসংহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
যদিও সৌদি পররাষ্ট্রনীতির নেতৃত্ব যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নিজেই দিয়ে থাকেন, এই দুই কর্মকর্তা নিয়মিতভাবেই তার পাশে থাকেন।