বোয়িংয়ের নিরাপত্তা মানদণ্ড নিয়ে উদ্বেগ তোলায় চাকরি হারাতে হয়েছে, দাবি বোয়িং মেকানিকের

বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছেই না বিমান নির্মাতা সংস্থা বোয়িংয়ের। এবার বোয়িং বিমান মেরামতের জন্য চুক্তিবদ্ধ একজন মেকানিক অভিযোগ করেছেন, বিমানের সুরক্ষা মানদণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় বরখাস্ত করা হয়েছিল তাকে। খবর বিবিসি'র।
রিচার্ড কুয়েভাস নামের ওই মেকানিক দাবি করেছেন, বোয়িং ৭৮৭ এর ফরোয়ার্ড প্রেসার বাল্কহেডে (বিমানের সামনের নোজ বা নাকের যন্ত্রাংশ) নিম্নমানের উৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণ প্রত্যক্ষ করায় এবং এ নিয়ে আওয়াজ তোলায় বোয়িং কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করে।
এভিয়েশনে ৪০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কুয়েভাস বোয়িং ৭৮৭ বিমানে স্পিরিট অ্যারোসিস্টেমের হয়ে কাজ করছিলেন। সুরক্ষা মানদণ্ড সম্পর্কে উদ্বেগ জানানোর পর তার অভিযোগগুলো স্পিরিট এবং বোয়িং উভয়ই উপেক্ষা করেছিল বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। এমনকি একজন সহকর্মী তাকে 'স্নিচ' বা 'গুপ্তচর' বলে সম্বোধন করেন বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের মার্চে কুয়েভাসকে বরখাস্ত করা হয়।
বোয়িং বিবিসিকে জানিয়েছে, 'একজন সাব-কন্ট্রাক্টরের কর্মী আমাদের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যা আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করেছি, কারণ আমরা সুরক্ষা সম্পর্কিত যে কোনো বিষয় গুরুত্ব সহকারে নিই। তবে, উত্থাপিত সমস্যাগুলো সুরক্ষা উদ্বেগ তৈরি করেনি এবং এটি সমাধান করা হয়েছে।'
স্পিরিট অ্যারোসিস্টেমসের মুখপাত্র জো বুচিনো বলেছেন, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন। তিনি বলেন, 'কোনো বিষয় নিয়ে সন্দেহ বা উদ্বেগ থাকা সকল স্পিরিট কর্মীদের এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করি আমরা।'
কুয়েভাসের আইনজীবী ডেবরা কাটজ এবং লিসা ব্যাংকস এর আগে আরেক বোয়িং হুইসেলব্লোয়ার স্যাম সালেহপৌর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, যিনি এই বছরের শুরুতে মার্কিন কংগ্রেসকে বলেছিলেন যে বোয়িংয়ে মানের সমস্যা রয়েছে বলে অভিযোগ করার পরে তাকে হয়রানি ও হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার সিরিজের সব বিমানে গুরুতর যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে বলে দাবি করেছিলেন বোয়িংয়ের সাবেক কোয়ালিটি ইঞ্জিনিয়ার স্যাম সালেহপৌর।
মার্কিন গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্যাম বলেন, এই ত্রুটি ঠিক করা না হলে ৭৮৭ ড্রিমলাইনার সিরিজের উড়োজাহাজ হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে মাঝপথেই 'ভূপাতিত' হয়ে যেতে পারে। তিনি অভিযোগ করেছেন, ৭৮৭ ও ৭৭৭ মডেলের জেট তৈরি করতে 'শর্টকাট' পথ বেছে নিয়েছে বোয়িং। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পর তাকে 'চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয়' বলে দাবি করেন স্যাম। তবে বোয়িং বলেছে, এই প্রকৌশলীর দাবিটি 'ভুল' এবং তারা আত্মবিশ্বাসী যে তাদের বিমান নিরাপদ।
এদিকে গত এপ্রিলে বোয়িং জানিয়েছিল, তাদের কর্মীদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়ার পর তাদের কথা বলার সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, 'আমরা নিরাপত্তা ও গুণমানকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখছি এবং আমাদের নিয়ন্ত্রক, গ্রাহক এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে স্বচ্ছতার সঙ্গে তথ্য শেয়ার করছি।'
উল্লেখ্য, বোয়িং-এর বিরুদ্ধে দুটি মারাত্মক দুর্ঘটনার সাথে সম্পর্কিত একটি নিষ্পত্তি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করার প্রমাণ পাওয়ায় মার্কিন বিচার বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনার সুপারিশ করেছেন মার্কিন প্রসিকিউটররা। মার্কিন বিচার বিভাগকে আগামী ৭ জুলাইয়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বোয়িংকে বিচারের আওতায় আনা হবে কিনা।
পাঁচ বছর আগে বোয়িং তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হয়েছিল যখন দুটো নতুন ৭৩৭ বোয়িং ম্যাক্স বিমান প্রায় একই ধরনের দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এবং তাতে ৩৪৬ জন নিহত হন।
এই দুটি মারাত্মক ৭৩৭ ম্যাক্স বিমান দুর্ঘটনায় ভুল তথ্য দিয়ে ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এয়ার সেফটি কন্ট্রোলারদের বিভ্রান্ত করেছে— এমন অভিযোগ আসার পর বোয়িং সেটি সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০২১ সালে একটি নিষ্পত্তি চুক্তি করার পর ফৌজদারি অভিযোগ থেকে রক্ষা পায়।
চুক্তি অনুযায়ী, বিচার বিভাগ বোয়িং এর বিরুদ্ধে ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সাথে প্রতারণার অভিযোগে মামলা না করতে সম্মত হয়েছিল যদি সংস্থাটি বাহ্যিক নিয়ম ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ মেনে চলে এবং নিয়মিত প্রতিবেদন জমা দেয়। বোয়িং তদন্ত নিষ্পত্তি করতে ২.৫ বিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতেও রাজি হয়েছিল।
কিন্তু এই বছরের জানুয়ারিতে আলাস্কা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের সময় বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানের একটি দরজার প্যানেল খুলে যাওয়ার ঘটনায় বোয়িংয়ের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করার বিষয়টি প্রসিকিউটরদের নজরে আসে।
এ ব্যাপারে বোয়িং কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। মার্কিন বিচার বিভাগের একজন মুখপাত্রের কাছে মন্তব্য চাওয়া হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন