ইউক্রেনের লক্ষ্যবস্তুতে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কতোটা নির্ভুলভাবে আঘাত হানছে? এর নেপথ্যে কাজ করছে কারা?

ইউক্রেনে সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নেপথ্যে ভূমিকা রাখছে রুশ সেনাবাহিনীর গোপন একটি সামরিক ইউনিট। এর অধিকাংশ সদস্যই তরুণ প্রকৌশলী ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিশেষজ্ঞ। খবর ইউরেশিয়ান টাইমসের
জার্মানি-ভিত্তিক ওপেন সোর্স অনুসন্ধানী গ্রুপ বেলিংক্যাট এবং স্বাধীন একটি গণমাধ্যম- দ্য ইনসাইডার-এর যৌথ তদন্তে, এই দলের ৩০ জন প্রকৌশলীকে শনাক্ত করা হয়েছে। যৌথ এ অনুসন্ধানের প্রতিবেদনটি গত ২৪ অক্টোবর প্রকাশিত হয়।
অনুসন্ধানে উঠে আসে রাশিয়ার জেনারেল স্টাফ মেইন কম্পিউটার সেন্টারের (এমসিসি) অধীনে আছে এই গোপন ইউনিট। এটির সংক্ষিপ্ত নাম- 'জিভিসি'। দলটির প্রধান দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এমন মিসাইলকে গতিপথের দিকনির্দেশনা, লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান (কো-অর্ডিনেটস) সরবরাহ করা। এমসিসির প্রধান মেজর জেনারেল রবার্ট ব্যারানভের ফোনকল রেকর্ড পরীক্ষা করে এবিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে ইনসাইডার।
ইনসাইডার তাদের অনুসন্ধানকালে আবিষ্কার করে যে, কর্নেল ইগোর বাগনিয়ুকসহ এমসিসি'র কর্মকর্তা হিসেবে এরমধ্যেই যাদের পরিচয় সম্পর্কে জানা গেছে– তাদের সকলের ঠিকানা– ১৯ জানমেঙ্কা সড়ক।
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এপ্রিলের শেষপর্যন্ত এই ঠিকানায় এসেছে নির্দিষ্ট একটি নম্বর থেকে ফোনকল। এই সময়ে যখনই কোনো ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করেছে রাশিয়া– তখনই সেখানে ফোন করা হয়েছে।
অনুসন্ধানী টিমটি কর্নেল বাগনিয়ুকের কল রেকর্ড পরীক্ষা করার সময় দেখতে পায়– এমসিসি'র ২০ জন সামরিক প্রকৌশলী ও আইটি বিশেষজ্ঞের সাথে তার রয়েছে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। বার বার করা ফোনকলের সূত্রে, বাগনিয়ুকের অধীনে কাজ করা ৩৩ জন সামরিক প্রকৌশলীকে শনাক্ত করেছে অনুসন্ধানী টিম।
বেলিংক্যাটের তথ্য সাহায্য নিয়ে এরপর বেশকিছু ক্রুজ মিসাইল হামলার সাথে নির্দিষ্ট একটি এমসিসি ইউনিটের সংযোগও খুঁজে পায় ইনসাইডার।
গোপন জেভিসি ইউনিটের একেক সদস্য একেক ধরনের মিসাইলে কো-অর্ডিনেট পাঠাতে সিদ্ধহস্ত। এ বিষয়টি তখনই জানা যায়, যখন অনুসন্ধানে দেখা যায়– ধরন অনুসারে এমসিসি'র কোন বিশেষজ্ঞকে কোন মিসাইলকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে।
গণমাধ্যমটির প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, এমসিসির ইউনিট তিনটি টিমের সমন্বয়ে গঠিত। একেকটি টিম একেক ধরনের হাই-প্রিসিশান মিসাইলের গতিপথ প্রোগ্রাম করে থাকে।
লক্ষ্যবস্তুতে সুনির্দিষ্টভাবে আঘাত হানার ক্ষমতাসম্পন্ন এই মিসাইলগুলি হলো– জেডএম-১৪ (ক্যালিবার- জাহাজ থেকে নিক্ষেপযোগ্য); ৯এম ৭২৮ (বা আর-৫০০, ইস্কান্দার- ভূমিভিত্তিক) এবং এক্স-১০১ (বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য)।
মিসাইলগুলির প্রোগ্রামিংয়ে জড়িত ইঞ্জিনিয়াররা এসেছেন বহুবিধ ক্ষেত্র থেকে। বেলিংক্যাট জানায়, 'এদের কেউ ছিলেন নৌবাহিনীতে জাহাজের ক্যাপ্টেন বা জাহাজের প্রকৌশলী। কারো কারো আছে ইতঃপূর্বে বেসামরিক খাতের কর্পোরেট আইটি বিশেষজ্ঞ বা গেম ডিজাইনার হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা'।

বিশেষজ্ঞদের নম্বর শনাক্তের পর তাদের সবাইকে একে একে ফোন করে ইনসাইডার। এসময় তারা সকলেই মিসাইল গাইডেন্স প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তারা এমসিসি'তে কর্মরত বা ইউক্রেনে মিসাইল হামলার নেপথ্যে রয়েছেন– এসব বিষয়কে সরাসরি অস্বীকার করেন।
অস্বীকার করলেও জিভিসি'র প্রতীক চিহ্নিত ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় তাদের সবার ছবি পাওয়া গেছে। এগুলি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করার হলে– তারা আর সাংবাদিকদের ফোনকল বা টেক্সট বার্তা রিসিভ করেননি। তারা রুশ সামরিক বাহিনীতে কাজ না করারও দাবি করেন।
ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পরিচালনার প্রক্রিয়া
মিসাইল হামলার পরিকল্পনা পর্বটিও তুলে ধরে ইনসাইডার। এর মূল সূত্র হিসেবে একজন জিভিসি সদস্যের কথা জানানো হয়। নাম না প্রকাশের শর্তে, তিনি এই প্রক্রিয়াটি ইনসাইডারকে ব্যাখ্যা করেন।
'মিসাইল উৎক্ষেপণের আগে প্রি-ফ্লাইট প্ল্যানিং করার দরকার হয়। এতে উৎক্ষেপস্থল থেকে লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত– মিসাইলের গতিপথের সম্পূর্ণটা দিতে হয়। ক্ষেপণাস্ত্রে এসব নির্দেশনা লোড করেন একজন প্রোগ্রামার।মিশনের প্রয়োজন অনুসারে, তিনি ফ্লাইটপাথে (গতিপথ) কাঙ্ক্ষিত যেকোনো পরিবর্তনের অ্যালগরিদম সাজিয়ে এ কাজটি করেন। এরপর সেটি ভরা হয় একটি অতি-সুরক্ষিত পেনড্রাইভে। এরপর সেটিকে সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া দেওয়া হয়- উৎক্ষেপণস্থলে, যেখানে মিসাইলটি রয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রের কম্পিউটারে পেনড্রাইভটি যুক্ত করা মাত্র সে নতুন কম্যান্ড অনুসারে রি-প্রোগ্রাম হয়ে যায়' – ব্যাখ্যা করেন ওই সদস্য।
গত থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইউক্রেনে সবচেয়ে বেশি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। এতে নিহত হন ৭০ ইউক্রেনীয়, ধবংস হয় দেশটির ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।
বেলিংক্যাট, দ্য ইনসাইডার ও ডের স্পিগেল- এর এক যৌথ প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত ২ অক্টোবর থেকেই এই হামলার পরিকল্পনা শুরু করে জেভিসি।
ইউক্রেনীয় বেসামরিক স্থাপনায় এই আঘাতকে 'সন্ত্রাসী হামলা' বলে উল্লেখ করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি।
তবে ইনআইডারের প্রতিবেদনে বলা হয়, আর পাঁচজন অফিস কর্মীর মতোন ধরাবাঁধা রুটিনে আটপৌরে কাজ করেন এমসিসি'র কর্মীরা। অর্থাৎ, তাদের কোনো ধরনের সন্ত্রাসের মনোভাব নেই। তারা শুধু হাইকম্যান্ডের নির্দেশ পালন করেন। এই চাকরিতে প্রায়ই একটানা দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে হয় তাদের।

টিমটির দৈনিক কর্মতালিকার মধ্যে রয়েছে– মিসাইলের গতিপথ পরিকল্পনা, আক্রমণের নির্দেশ সম্বলিত থাম্ব ড্রাইভ তৈরি, এবং রাশিয়ার ভাণ্ডারে থাকা দূরপাল্লার কোন ক্ষেপণাস্ত্রটি নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস কতোটা সক্ষম– তা যাচাই করা।
যৌথ অনুসন্ধানী দলটি তাদের প্রতিবেদনের উপসংহারে জানায়, তারা নিশ্চিত যে জিভিসি'র 'মিসাইল প্রি-প্ল্যানার্স সাব-ইউনিটের' প্রধান হলেন কর্নেল ইগোর বাগনিয়ুক। বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে তারা ইউনিটের এক সদস্যের সাথে যোগাযোগ করে। তার পাঠানো একটি ছবিতে বাগনিয়ুকসহ টিমের অন্য সদস্যরাও রয়েছে'।
এদিকে লাটভিয়ায় নিবন্ধিত দ্য ইনসাইডার ও বেলিংক্যাট'কে 'বিদেশি চর বা এজেন্ট' সংস্থার তালিকাভুক্ত করেছে রাশিয়া। মস্কো জানায়, চলতি বছরের তাদের প্রকাশনা কাজ ছিল গর্হিত ও অগ্রহণযোগ্য। যেসব রুশ নাগরিক এসব প্রকাশনার কাজে সাহায্য করেছে বলে প্রমাণ মিলবে– তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে।
তবে আলোচিত এই প্রতিবেদনটি সঠিক হলে, ইউক্রেনে বেশিরভাগ রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নেপথ্য কারিগর এমসিসি'র এই ইউনিটের সদস্যরাই।