১১১ বছরের সাধনা ঔষধালয়: বিশ্বজোড়া খ্যাতি থেকে এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে
ঢাকার গেন্ডারিয়া। দীননাথ সেন রোডের ৭১ নম্বর রোডের বিরাট কারখানার এক ছোট্ট ঘরে যোগেশচন্দ্র ঘোষ চল্লিশ পাওয়ারের হলুদ আলোর নিচে নতুন এক ওষুধের সূত্র লিখছেন। গায়ে ফিনফিনে চাদর, ধুতিটি হাঁটুর। কে বলবে তিনি কোটিপতি! ১৯৫০-৬০-এর দশকে সারা ভারতে সাধনা ঔষধালয়ের দেড়শোর বেশি শাখা, আর এজেন্সি দুই হাজারের বেশি। বিশেষ করে বিহার আর আসামে সাধনার ওষুধের তুঙ্গ চাহিদা। যোগেশবাবু আশা করেন, সাধনার শাখা খুলবেন ইউরোপ আর আমেরিকাতেও।
তারও অনেক আগে আচার্য প্রফুলচন্দ্র রায় দিন কয়েকের জন্য ঢাকায় এলে সাধনার কারখানা ঘুরে ঘুরে দেখেন, খবর দিচ্ছেন শিশির পত্রিকার সম্পাদক শিশির কুমার মিত্র। আচার্য যোগেশবাবুকে নানা কথা জিজ্ঞেস করেন এবং আয়ুবের্দের প্রণালী যথাযথ অনুসরণ হচ্ছে দেখে আনন্দ প্রকাশ করেন। অফিসের কাগজপত্রে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে অসংখ্য অর্ডারের চিঠি দেখে, বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে সাধনার ওষুধের অর্ডার আসছে দেখে যোগেশবাবুকে অভিনন্দন জানান আচার্য।
যোগেশবাবু কলেজ জীবন থেকেই রসায়ন শাস্ত্রে অনুরাগী হয়ে ওঠেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বিএ পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এমএ অধ্যয়নের জন্য। এখানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাকে দেশজ সম্পদ ব্যবহার করে ওষুধ প্রস্তুতে উৎসাহ প্রদান করেন। তাই বিদেশি ওষুধের পরিবর্তে তিনি গাছ-গাছড়ার মাধ্যমে চিকিৎসা করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আর সেটা ছিল এমন এক সময় যখন ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষিতে সারা ভারত, বিশেষত বঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার বইছে। বিলেতী পণ্য বর্জনের উদ্দীপনা ঘরে ঘরে। কিন্তু বর্জনের সঙ্গে অর্জনও দরকার। শুধু বর্জন করলে মানুষ পরবে কী, খাবে কী? তাই চরকা ঘুরল, ধোঁয়া উড়ল চিমনি ফুঁড়ে। অবশ্য স্বদেশী আন্দোলন জোর জমাট বাঁধার আগে থেকেই দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের হাওয়া চালু হয়ে গিয়েছিল। যেমন ১৮৯০ সালে হেমেন্দ্রমোহন বসু চালু করেছিলেন সিলিন্ডার রেকর্ড, কুন্তলীন তেল, দেলখোস সুবাস এবং তাম্বুলিন পানমশলা। ১৯০১ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় চালু করেন বেঙ্গল কেমিক্লযাস। বিখ্যাত সুগন্ধী বিজ্ঞাপন 'ফরগেট মি নট'-এর সেই সুগন্ধী পি এম বাগচী অ্যান্ড কোং-এর। কিশোরীমোহন বাগচী চালু করেন এই কোম্পানি। কলমের কালি দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হলেও ওষুধ, সিরাপ, সুগন্ধী আর রাবার স্ট্যাম্পও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল পুরো ভারত আর বাংলাজুড়ে।
বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোং তাদের নিজস্ব ফর্মুলায় তৈরি করেছিল ম্যালেরিয়ার ওষুধ। ব্রিটিশ সৈন্যদের মাঝেও তখন কুইনাইনকে ছাড়িয়ে ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে খ্যাতি পায় বটকৃষ্ণ পালের নতুন ফর্মুলা। বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পর আরো চালু হয় বেঙ্গল পটারি, বেঙ্গল গ্লাস ওয়ার্কস, বন্দে মাতরম ম্যাচ ফ্যাক্টরি, বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিলস, বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ, সেন র্যালি বাইসাইকেল কোম্পানিসহ আরো অগুণিত কোম্পানি চালু হয় পুরো বাংলায়।
খাওয়া, পরা, থাকার সঙ্গে চিকিৎসাও মৌলিক অধিকার। তাই প্রফুল্লচন্দ্র যখন দেশীয় উপকরণে ওষুধ প্রস্তুতের মাধ্যমে দেশসেবার কথা তুললেন তখন যোগেশবাবুর ভাবনায় নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। তিনি রসায়নে উচ্চ শিক্ষা নিতে ১৯০৮ সালে গেলেন ইংল্যান্ডে, তারপর আমেরিকায়। ফিরে এসে আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে ভাগলপুর কলেজে অধ্যাপনায় যুক্ত হন। চার বছর ছিলেন ভাগলপুরে। এই সময়ে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র নিয়ে বিস্তৃত অধ্যয়ন করেন। এ চিকিৎসা পদ্ধতি পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। ভারতবর্ষে এর উদ্ভব। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে এই চিকিৎসা পদ্ধতি বিশেষভাবে পরিচিত। সংস্কৃত শব্দ আয়ু ও বেদ থেকে আয়ুর্বেদ শব্দের উৎপত্তি। আয়ু মানে জীবন আর বেদ অর্থ বিদ্যা। যে জ্ঞানের মাধ্যমে জীবের কল্যাণ সাধন হয় তা-ই আয়ুর্বেদ। সাম্প্রতিক সময়ে করোনা প্রাদুর্ভাবে যখন অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি কাজে আসছিল না তখন বিভিন্ন দেশে আয়ুর্বেদ পদ্ধতিতে চিকিৎসা চালানো হয় এবং ভালো ফলও পাওয়া যায়। কারণটি হলো আয়ুর্বেদ কেবল রোগের উপশম ঘটায় না, বরং রোগীর উন্নতি সাধন করে। উপনিবেশিক আমলে এ চিকিৎসা পদ্ধতিকেও আড়াল করার চেষ্টা চলে। তবে উনিশ শতকের শেষভাগে এটি পুনরুজ্জীবন লাভ করে ভারতবর্ষে এবং বহির্বিশ্বেও। ঐতিহ্যবাহী তিব্বতী ও চীনা ওষুধ আয়ুর্বেদ থেকে উদ্ভূত। প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসা পদ্ধতির অনেক সূত্রও আয়ুর্বেদ থেকে ধার করা।
চিরতার রস খেয়ে পরিপাক ঠিক রাখা, সজনে পাতা খেয়ে ওজন কমানো, ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে নিম চন্দনের ব্যবহারের সূত্রগুলো এসেছে আয়ুর্বেদ থেকে। সকালে দশন-সংস্কার দিয়ে দন্তমাজন, অধিক ভোজনের পর লবণ ভাস্কর চূর্ণ এখনো অনেকের নিত্যকার অভ্যাস। জন হপকিন্স মেডিক্যাল জার্নাল জানাচ্ছে, মূলত মন, শরীর, আত্মা ও পরিবেশের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করে আয়ুর্বেদ যার কোনোটিতে ব্যাঘাত ঘটলেই রোগ হয়। আয়ুর্বেদে তাই রোগের চিকিৎসায় ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে তা পূর্বাবস্থায় ফেরানোর চেষ্টা চলে। সাধারণত ভুল খাদ্যাভ্যাস, ত্রুটিপূর্ণ জীবনযাপনের কারণে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়। আয়ুর্বেদে তাই সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি সার্বিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা হয় । আয়ুবের্দের ওষুধ তৈরি করা হয় গাছপালা, ফুল, ফল আর শেকড় বাকড় দিয়ে।
যত জানলেন ততই যোগেশ চন্দ্র এ চিকিৎসা পদ্ধতিতে আকৃষ্ট হলেন। আয়ুর্বেদকে তিনি বেছে নিলেন মানবসেবা আর দেশসেবার উপায় হিসেবে। ভাগলপুরে চার বছর কাটিয়ে তিনি যোগ দিলেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। ১৯১২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে অধ্যাপনা করেন। অবসরের আগে তিনি কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন যার কারণে অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র নামেই অধিক পরিচিতি লাভ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নতি সাধন ও জনপ্রিয় করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং এ বিষয়ক বইপত্র লেখা শুরু করেন। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে আছে অগ্নিমান্দ্য ও কোষ্ঠবদ্ধতা, আরোগ্যের পথ, আয়ুর্বেদীয় গৃহ চিকিৎসা, চর্ম ও সাধারণ স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, চক্ষু কর্ণ নাসিকা ও মুখরোগের চিকিৎসা। ভাগলপুর থেকে ঢাকায় আসার দুই বছর পর ১৯১৪ সালে তিনি গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডে প্রতিষ্ঠা করেন সাধনা ওষধালয়। তখন এটি ছিল একটি ছোটখাটো আয়ুর্বেদীয় গবেষণাগার। তার সক্রিয় তত্ত্বাবধানে এখানে নানা রকম ওষুধ তৈরি হতে থাকে। অনেক মানুষ সাধনার ওষুধ সেবন করে ভালো ফল পেতে থাকলে তৈরি হয় বিপুল চাহিদা। তাই ওই ছোট্ট কারখানায় আর সংকুলান হচ্ছিল না। তাই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ কারখানা গড়ে তোলেন। ১৯১৭ সালে তিনি বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রপাতির সাহায্যে বাণিজ্যিকভাবে ওষুধ উৎপাদন শুরু হয়। সাধনার প্রতিটি শাখায় অভিজ্ঞ কবিরাজ বা বৈদ্যেও সহায়তায় স্বল্পমূল্যে রোগের ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হতো। বিখ্যাত টুথ পাউডার সাধনাদশন থেকে শুরু করে শ্রী গোপালতেল তার নিজস্ব সৃষ্টি। অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র তার আয়ুর্বেদীয় গৃহ চিকিৎসা গ্রন্থে বলেন, আয়ুর্বেদের চ্যবনপ্রাশ, মকরধ্বজ প্রভৃতি চিকিৎসা বিজ্ঞানের একেকটি উজ্জ্বল রত্ন। এগুলি বিদেশে প্রচার করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন সম্ভব। বিদেশি ওষুধ ভারতে বিক্রি হওয়ার ফলে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা লুট হয়ে যায়। এদেশে ডাক্তারদের মধ্যে যে কোনো ব্যক্তি মকরধ্বজ, চ্যবনপ্রাশ, অশোক ঘৃত প্রভৃতি আয়ুর্বেদিক ওষুধ বিদেশে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে জন্মভূমিকে সমৃদ্ধশালী করে তুলতে পারেন।'
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রকে তিনি মানবসেবায় যেমন দেশসেবারও উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আয়ুর্বেদীয় গৃহ চিকিৎসা গ্রন্থে তিনি আরো লিখেছেন, "সাধনা ওষুধালয় আমার জীবনের প্রিয়তম প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ব্যক্তিগত কল্যাণের উর্ধ্বে উঠিয়া দেশের বৃহত্তমম কল্যাণ কামনায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করিলে সেই প্রতিষ্ঠান দেশেরও প্রিয়তম হয়। ভারতবর্ষের বাহিরে বিদেশে সাধনা ওষধালয়ের ব্রাঞ্চ স্থাপন করিবার জন্য যখন চেষ্টা করি, তখন আমি ভাবি যে, আমি আয়ুর্বেদের সেবক, ভারতবর্ষের গণশক্তির অংশ। দেশে নব জাগরণের যে সাড়া পড়িয়াছে, তাহা আমাকে সাধনা ওষধালয়ের বিস্তৃতি কার্যে প্রচুর পরিমাণ প্রেরণা দিয়া থাকে।"
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুও সাধনা ওষধালয় পরিদর্শন করেন। তিনি যোগেশচন্দ্রের ছেলে ডাঃ নরেশচন্দ্র ঘোষকে ধন্যবাদ পত্র লিখেছিলেন। তাতে উল্লেখ করেছিলেন, "ঢাকার সাধনা ওষধালয় পরিদর্শন করে মুগ্ধ হয়েছি। এর অকৃত্রিমতা সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ।অধ্যক্ষ মহাশয়ের জনহিতৈষণার মনোভাবও বিশেষ প্রশংসার যোগ্য। ঢাকার এই সর্বপ্রধান ওষধালয়ের কর্তৃপক্ষ যেরূপ নিষ্ঠা ও সফলতার সঙ্গে আয়ুর্বেদের সেবা করছেন তাতে আমি তাদের অভিনন্দিত না করে পারলাম না।"
কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জ¦রের জন্য সাধনার ওষুধ ব্যতিত অন্য কিছুর ওপর ভরসা করতেন। সাধনার সর্বব্যাপী প্রসারের পিছনে বড় কারণ ছিল যোগেশ বাবুর আন্তরিকতা ও সুলভ মূল্যে ওষুধ প্রাপ্তি। টাকা-আনা-পাইয়ের আমল যখন ছিল তখন মৃত সঞ্জীবনীর ছোট এক বোতলের দাম ছির ১৪০ আনা। এটি একইসঙ্গে জ¦র, রক্তল্পতা, অজীর্ন, অগ্নিমান্দ্য, সূতিকা এবং বাতের জন্য উপকারী। সারিবাদি সালসা প্রতি শিশির দাম ছিল ৪০ আনা। এটি রক্ত পরিস্কার ও রোগজীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করে। সর্বজ¦র বটী ছিল ১৬ বটী একসঙ্গে ১ আনা। এটি যে কোনো জ¦র রোগের অব্যর্থ ওষধ হিসেবে গণ্য হতো। চ্যবনপ্রাশের প্রতি সেরের দাম ছিল ৩ টাকা। এটিকে বলা হতো কফ, কাশি-সর্দি, যক্ষ্মা ও হৃদরোগের মহৌষধ।
যোগেশচন্দ্র জন্মেছিলেন ১৮৮৭ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুর তথা শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার জলছত্র গ্রামে। গ্রামের স্কুলে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। পওে তিনি ঢাকার জুবিলি স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে পড়ার সময় তিনি স্বদেশী আন্দোলনে আগ্রহী হন, কলেজে পড়ার সময় তা আরো বৃদ্ধি পায়। সাধনা প্রতিষ্ঠাকালে তিনি যেমন জাতীয় আয়ুর্বেদিক শিল্প গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন, সেসঙ্গে কর্মসংস্থান তৈরির কথাও ভেবেছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই সাধনার খ্যাতি ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হলো দেশভাগের পর। ভারত সরকার পাকিস্তান থেকে আমদানি করা কিছু জিনিসের ওপর শুল্ক চালু করে। আয়ুর্বেদিক ওষধের ওপর ছিল শতকরা ৩৬ ভাগ। সীমান্তের উভয় পাশে শুল্ক বিভাগের তথ্য-তথ্য তল্লাশি ও শুল্কের চাপ বাড়ছিল। তাই ঢাকা থেকে ভারতের সাধনা ওষধালয়ের শাখাগুলিতে ওষধপত্র পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। এই সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য কলকাতায় কাজ শুরু হয় এবং ১৯৫০ সালে দমদমে তার নিজের বাড়িতে সাধনা ওষধালয়ের দ্বিতীয় কারখানা স্থাপিত হয়। কলকাতার কারখানা পরিচালার দায়িত্ব দেন পুত্র ডাঃ নরেশচন্দ্র ঘোষের ওপর। তিতি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছিলেন, পাশাপাশি আয়ুর্বেদ শাস্ত্র চর্চার জন্য আয়ুর্বেদাচার্য্য উপাধি লাভ করেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সাধনাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে নরেশচন্দ্রের ভূমিকা ছিল অসামান্য। দেশভাগের পরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত-সংঘর্ষের মধ্যেও যোগেশচন্দ্র মাতৃভূমিতেই অবস্থান নিলেন এবং নতুন নতুন ওষধ প্রস্তুত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। পিতা-পুত্রের প্রচেষ্টায় আটশর মতো ওষধ তৈরি হয়েছিল সাধনায়।
ভারতের আয়ুর্বেদ ওষধের চাহিদা ও বিক্রয় ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ২০১৪ সালে বাজারটি ছিল ২.৮৫ বিলিয়ন ডলারের, ২০২৪ সালে যা বৃদ্ধি পেয়ে সাড়ে দশ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। পতঞ্জলী, ডাবুর, বৈদ্যনাথ, ঝান্ডু কোম্পানির ঔষধ সারা বিশ্বে রপ্তানি করে ভারত। কিন্তু এ সব কিছুর আগে, বাংলায় তৈরি আয়ুর্বেদিক ওষুধের বিশ্ববাজার তৈরি করেছিলেন যোগেশচন্দ্র ঘোষ।
একসময় সাধনা ঔষধালয়ের শাখা সুদূর চীন আর উত্তর আমেরিকাতেও ছিল। আর সাধনার ঔষধ রপ্তানি হতো আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান আর চীনে।
'মরতে হয় তো দেশের মাটিতেই মরবো'
যোগেশচন্দ্র ঘোষের দেশপ্রেমের নজির আমরা দেখেছি আগেই। আমেরিকার বিলাসী জীবন ছেড়ে দিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন কলেজে মাস্টারি করার জন্য। সাধনা ঔষধালয়কে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যান নিজের পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে। কারখানা বাউন্ডারিতেই তার বাসা ছিল।
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। এপ্রিল মাসেই পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর এলাকার অধিকাংশ হিন্দু নিবাসীরা ভারতে চলে গিয়েছিলেন। যোগেশচন্দ্র ঘোষও তার পরিবারের সকল সদস্যকে পাঠিয়ে দেন ভারতে। কিন্তু পরিবার আর কর্মচারীদের শত অনুরোধ সত্বেও নিজে ভারতে যাননি বৃদ্ধ যোগেশচন্দ্র। দেশেই তার সাথে থেকে গেল বিশ্বস্ত দুই দারোয়ান সুরুজ মিয়া আর রামপাল।
৩ এপ্রিল গভীর রাতে পাকবাহিনীর মিলিটারি এসে হাজির হলো সাধনা ঔষধালয়ের গেটে। গেটের তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে একনাগাড়ে চালাল গুলি। দারোয়ান সুরুজ মিয়াও পাল্টা গুলি চালান তাদের প্রতিহত করার জন্য। আকস্মিক প্রতিরোধে ঘাবড়ে যায় মিলিটারিরা। সেদিনের মতো ফিরে যায় তারা।
এ ঘটনার পর সুরুজ মিয়া আবার করজোড়ে অনুরোধ করেন যোগেশচন্দ্রকে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অশীতিপর যোগেশচন্দ্র ঘোষ তার সিদ্ধান্তে অনড়। তিনি বলেন, 'মরতে হয় তো এ দেশের মাটিতেই মরবো।'
৪ এপ্রিল সকালে আরো অস্ত্র নিয়ে ফিরে আসে পাকবাহিনী। সুরুজ মিয়া, রামপাল আর কিছু কর্মচারীকে অস্ত্রের মুখে দাঁড় করিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায় তারা। প্রথমে কাপুরুষের মতো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, তারপর গুলি করে মেরে ফেলা হয় বাংলার কৃতি সন্তান যোগেশচন্দ্র ঘোষকে।
দেশ স্বাধীনের পর যোগেশচন্দ্র ঘোষের ছেলে ডা. নরেশচন্দ্র ঘোষ আবার সাধনা ঔষধালয়কে দাঁড় করান। যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবেই তিনি সাধনার হাল ধরেছিলেন। জাতির জন্য আত্মদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯১ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে যোগেশচন্দ্র ঘোষের নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ ডাক বিভাগ।
আজকের সাধনা
সাধনা ঔষধালয়ের প্রধান কার্যালয় আর কারখানার পাশেই একটি শাখা আছে। সে শাখার দায়িত্বে আছেন চিত্তরঞ্জন দাস। ৩৬ বছর ধরে তিনি আছেন সাধনা ঔষধালয়ের কর্মচারী হিসেবে। তিনি বলেন, 'নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত সাধনা ঔষধালয়ের খ্যাতি ছিল অনেক। দেশে প্রযুক্তি আসার পরে মানুষ আয়ুর্বেদ ঔষধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে সমাজের উচ্চ স্তরের মানুষেরা, যারা আগে নিয়মিত আয়ুর্বেদীক ঔষধের ওপরই ভরসা রাখত, তারা হঠাৎ করেই অ্যালোপেথিতে চলে যায়। তবে এখনো আমাদের অনেক ঔষধই বিক্রি হয়। নিয়মিত কিছু কাস্টমার আছে, যারা কয়েক পুরুষ ধরে সাধনার ওপর ভরসা রেখেছে। আমরা তাদের জন্যই টিকে আছি।'
অনেক ওষুধ তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করাও এখন অনেক কঠিন বলে জানান চিত্তরঞ্জন বাবু।
এখনো সাধনার ঔষধের দাম অনেক কম। ২৫০ গ্রাম চ্যবনপ্রাশের দাম ২২০ টাকা। ৫০ গ্রাম দশন চূর্ণের (দাঁতের মাজন) দাম মাত্র ৮৫ টাকা। সাধনা ঔষধালয়ের বেশিরভাগ ঔষধ ৫০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়।
চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, 'আমরা ঔষধের দাম বাড়াই না। দশকের পর দশক ধরে একই দামে বিক্রি হয় সব ঔষধ। কাঁচামাল, দোকানের ভাড়া, কর্মীদের বেতন সবই নিয়ম করে বৃদ্ধি পায় প্রতি বছর। কিন্তু ঔষধের দাম বাড়ানো হয় না। এটার জন্য কিছু ঔষধ উৎপাদন খরচের চেয়েও কমে বিক্রি করা লাগে। যেমন দশন চূর্ণ ৫০ গ্রাম বানাতে খরচ হয় ১৫০ টাকা। কিন্তু বিক্রি করা হয় ৮৫ টাকায়। যে লোকসান হয়, তা অন্য কোনোভাবে পুষিয়ে নেয়া হয়।'
সাধনার ঔষধ খেয়ে কেউ কোনো অভিযোগ জানিয়েছে কখনো? এই প্রশ্নের উত্তরে চিত্তবাবু বলেন, 'আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে সাধনার সেলসে আছি। এখনো কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেনি আমার কাছে। শুধু একটা বিষয়, পুরো ঔষধের কোর্স শেষ না করেই অনেকে ভাবে সেরে যাবে। কিন্তু এভাবে তো রোগ সারে না। তখন অনেকে জানিয়েছে ফল পায়নি। কিন্তু প্রশ্ন করলেই বেরিয়ে আসে যে তারা নিয়ম করে ঔষধ খায়নি।'
আজকের প্রকৃতিবান্ধব বিশ্বে আয়ুর্বেদিক ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। রোগীরা আর এন্টিবায়োটিক নিতে চাইছে না, কারণ এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। কলকাতায় সরকার পরিচালিত জেবি রায় আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ২০০-৩০০ মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে। কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জিসি পোল্লে বিবিসিকে বলেন, 'অনেক ক্ষেত্রেই অ্যালোপেথিক চিকিৎসার থেকে আয়ুর্বেদ বেশি কাজ দেয়, তাই এর জনপ্রিয়তা আবার বাড়ছে। অ্যালোপ্যাথিতে অ্যান্টিবায়োটিক বা ওই ধরনের ওষুধের সীমাবদ্ধতা আছে। অন্যদিকে আয়ুর্বেদেও মূল কথাই হলো রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এখানেই আমরা শ্রেষ্ঠ।'
সাধনা কি ফিরবে?
এখনো ভারতজুড়ে শতাধিক শাখা রয়েছে সাধনার। বছরে লাভ করে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। তবে অঙ্কটা দিন দিন কমছে। যেখানে সাড়ে ৪০০ ওষধ নিয়মিত উৎপাদিত হতো, সেখানে এখন হয় ১২০ রকমের। সাধনার ওষুধ আর রপ্তানি হয় না বললেই চলে, কারণ উপকরণের উচ্চ মূল্য এবং পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতা । এছাড়া আছে ভারত ও বাংলাদেশের নানান স্থানে ছড়িয়ে থাকা সাধনার বিশাল ভূসম্পত্তির তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণের অভাব।
তার ওপর ব্যবসায় মনোযোগ নেই সাধনার একমাত্র উত্তরাধিকারীর। নরেশচন্দ্রের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। কেউ বিয়ে করেননি। ছেলেরা মারা গেছেন। সম্পত্তি ও ইতিহাসের উত্তরাধিকার নিয়ে রয়ে গেছেন শীলা। ব্যবসা তার ধ্যানজ্ঞান নয়। নিজেকে আধ্যাত্মিকতায় ডুবিয়ে রেখেছেন। পুরনো কর্মচারীদেও অনেকেই বহুবার ওষুধের দাম বাড়ানোর কথা বলেছেন। বলেছেন, ব্যবসা ঘুরে দাঁড় করাতে ব্যবস্থা নেওয়া হোক, কথা বলা হোক সরকারের সঙ্গেও। শীলা সব শুনে হেসেছেন। বলেছেন, কী হবে টাকা বাড়িয়ে? কে খাবে? তার থেকে যতটা মানুষের উপকারে আসা যায় সেটাই দেখা উচিত।
