ঢাকার রাস্তায় হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে বিজ্ঞাপন, নতুন সেবা ‘হিউম্যান বিলবোর্ড’
বিকেলের আলো একটু ফিকে হলেই ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়েন একদল তরুণ। গন্তব্য—শহরের ব্যস্ত আর অভিজাত এলাকাগুলো। দলের প্রত্যেকের পিঠে একটি করে ব্যাগ, পরনে একই রকম পোশাক। ব্যাগগুলো আবার বিশেষ ধরনের—প্রতিটির সঙ্গে যুক্ত একটি করে ডিজিটাল স্ক্রিন। আর সেই স্ক্রিনই তাদের কাজের মূল মাধ্যম।
দিনের আলো ম্লান হওয়া মাত্রই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একের পর এক ছবি ও ভিডিও—বিভিন্ন পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন। শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পথচারীদের সেই বিজ্ঞাপনই দেখান তারা।
রাজধানীর নানা ট্র্যাফিক সিগন্যালে প্রায়ই দেখা যায় তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে। কখনো শপিং মলের সামনে, কখনো আবার ব্যস্ততম রেলস্টেশন বা বাসস্ট্যান্ডেও হাজির হন তারা। স্ক্রিনে অবিরাম চলে নানা পণ্যের ভিডিও প্রচার।
ঢাকা শহরে অভিনব এই চলমান বিজ্ঞাপন সেবা চালু করেছে 'স্মার্ট স্ক্রিন ডিজিটাল' নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
মানুষ যখন বিলবোর্ড
একসময় মানুষ পোশাক-পরিচ্ছদে নানা বক্তব্য লিখে প্রচার করত। ১৯ শতকে লন্ডনে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়। সেই প্রচারণার ধরনটির নাম ছিল 'হিউম্যান বিলবোর্ড'। এটি এমন এক সেবা, যেখানে মানুষ নিজের শরীরে বিজ্ঞাপন বহন করে শহরের ব্যস্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে প্রদর্শন করেন। আর এর আধুনিকতম সংস্করণ হলো এই ডিজিটাল হিউম্যান বিলবোর্ড।
শরীরে ডিজিটাল স্ক্রিন বহন করে পণ্যের প্রচার উন্নত বিশ্বে এখন বেশ জনপ্রিয়। আর সেই ভাবনাই বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করেছেন নেওয়াজ আকবর হোসাইন, 'স্মার্ট স্ক্রিন ডিজিটাল'-এর প্রতিষ্ঠাতা।
দুবাইয়ের রাস্তায় হিউম্যান বিলবোর্ড দেখে তার মনে হয়েছিল, এ ধরনের সেবার বাংলাদেশেও বড় সম্ভাবনা রয়েছে। সেই ভাবনা থেকেই দেশের বিজ্ঞাপন বাজার নিয়ে প্রায় এক বছর গবেষণা করেন তিনি। এ বছরের শুরুতে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি যন্ত্রপাতি নিয়ে শুরু হয় তাদের কার্যক্রম।
নেওয়াজ বলেন, "কোরিয়া, জাপান, দুবাইয়ে এই সেবাটি খুব প্রচলিত। দুবাইয়ে দেখলাম, এসব সেবা যারা দিচ্ছে তারা বেশিরভাগই ভারতীয় বা বাংলাদেশি। অথচ আমাদের দেশে এই উদ্যোগ নেই। তখনই ভাবলাম, আমরা যদি শুরু করতে পারি, তাহলে আমরা হবো প্রথম, আর বাংলাদেশের অ্যাড ইন্ডাস্ট্রিকেও আরও এগিয়ে নিতে পারব।"
শুরু করার আগে তিনি সম্ভাব্যতা যাচাই করেন এবং প্রস্তুতি শেষে দল নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেন। ইতোমধ্যে তাদের এই অভিনব বিজ্ঞাপন সেবা বেশ সাড়া ফেলেছে।
স্মার্ট স্ক্রিন ডিজিটালের সেলস ও মার্কেটিং বিভাগের দায়িত্বে থাকা ঐশিকা জয়া বলেন, "প্রতিমাসে আমরা ভালো পরিমাণ অর্ডার পাচ্ছি। সবাই চায় নিজের পণ্যটিকে নতুনভাবে, আলাদা করে মানুষের সামনে তুলে ধরতে। আমরা সেই কাজটিই করছি সবচেয়ে আকর্ষণীয়ভাবে।"
যে সেবাগুলো পাওয়া যায়
১৫ জনের একটি দল প্রায় প্রতিদিনই শহরের নির্ধারিত কিছু স্থানে পৌঁছে যান। প্রচারণা চলে বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। প্রতিদিনের এই চলমান প্রচারণা চলে ঢাকার ব্যস্ততম এলাকায়।
ঐশিকা জয়া বলেন, "গুলশান ১ ও ২, বনানী, তেজগাঁও, সীমান্ত স্কয়ার, রবীন্দ্র সরোবর লেক আর ধানমন্ডি ২৭ আমাদের ফিক্সড লোকেশন। তবে ক্লায়েন্টের প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা কাস্টমাইজড সেবাও দিয়ে থাকি।"
স্থান, সময় আর লোকবলের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ কাস্টমাইজড সেবা দেয়। কোন এলাকায় বিজ্ঞাপন প্রচার হবে, কতক্ষণ বা কতদিন চলবে—সব কিছুই নির্ধারণ করা যায় ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী। এমনকি, বিজ্ঞাপনবাহকের সংখ্যা কিংবা তাদের পোশাকের ধরনও নির্ধারণ করে দেওয়ার সুযোগ থাকে গ্রাহকের হাতে।
হিউম্যান বিলবোর্ড সেবার জন্য 'স্মার্ট স্ক্রিন ডিজিটাল'-এর রয়েছে প্রায় ৩০টি ডিজিটাল ব্যাকপ্যাক। প্রতিটি ব্যাগে থাকে শক্তিশালী ব্যাটারি ও প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ। প্রতিষ্ঠানটি এগুলো চীন থেকে আমদানি না করে নিজেরাই তৈরি করেছে।
টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সানাউল্লাহ শাওন বলেন, "ডিভাইসের কোনো সমস্যা দেখা দিলে আমরা নিজেরাই তা মেরামত করতে পারি। পুরো প্রযুক্তিটাই আমরা নিজেদের হাতে তৈরি করেছি।"
প্রচারণায় অংশ নেওয়া প্রতিটি দলে একজন করে টিম লিডার থাকেন। তার নির্দেশনায় কাজ করেন অন্য সদস্যরা। শুধু বিজ্ঞাপন প্রচারই নয়, তারা পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে পণ্য বা সেবার বিষয়ে তথ্যও দেন। ফলে ক্লায়েন্টরা পান এক ধরনের 'ওয়ার্ড অফ মাউথ' মার্কেটিং সুবিধা, যা প্রচলিত বিলবোর্ডের চেয়ে অনেক কার্যকর।
খরচ কেমন
গ্রাহকরা চাইলে নিতে পারেন দুই ধরনের বিজ্ঞাপন সেবা—'শেয়ারড' ও 'ডেডিকেটেড'।
শেয়ারড বিজ্ঞাপনে একসঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ক্রমান্বয়ে চলে। অন্যদিকে ডেডিকেটেড বিজ্ঞাপনে পুরো স্ক্রিনে শুধু একটি পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনই প্রচারিত হয়, ফলে এর খরচ তুলনামূলক বেশি।
নেওয়াজ আকবর হোসাইন জানান, "একটি স্ক্রিন যদি এক সপ্তাহের জন্য সার্ভিস দেয়, তবে খরচ পড়বে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। স্ক্রিন সংখ্যা বা সময় যত বাড়বে, খরচ তত কমবে। কাস্টমাইজড সেবার ক্ষেত্রেও দর আলোচনা করা যায়।"
তার মতে, তাদের এই সেবা শহরের অন্যান্য বিলবোর্ড বিজ্ঞাপনের তুলনায় অনেক বেশি সাশ্রয়ী ও কার্যকর।
তিনি বলেন, "আমাদের সার্ভিসের খরচ সাধারণ বিলবোর্ডের অর্ধেক, কিন্তু প্রভাব অন্তত তিনগুণ বেশি। কারণ বিলবোর্ড এক জায়গায় স্থির থাকে, আর আমাদের স্ক্রিন চলে শহরজুড়ে—তাই এর দৃশ্যমানতা ও প্রভাব অনেক বেশি।"
আগ্রহ বাড়ছে মানুষের
মোহাম্মদ বিল্লাল হোসাইন 'স্মার্ট স্ক্রিন ডিজিটাল'-এর একটি দলের টিম লিডার। তিনি জানালেন, যত দিন যাচ্ছে কাজের পরিমাণও বাড়ছে।
"আমরা অনেক কোম্পানির বিজ্ঞাপন করেছি," বললেন বিল্লাল। "পাঠাও-এর কাজ করেছি, তাণ্ডব মুভির ট্রেইলার প্রচার করেছি, চরকির বিভিন্ন প্রচারণাও করেছি।"
বিল্লালের মতে, সাধারণ মানুষের আগ্রহও দিন দিন বাড়ছে। "যখনই কোনো সিগন্যাল পড়ে, আমরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যাই। তখন সবার নজর থাকে আমাদের স্ক্রিনের দিকে। অনেকেই এসে জানতে চান—এটা কী, কেন আমরা এসেছি। তখন তাদের বুঝিয়ে বলতে হয়।"
বিল্লাল দিনের বেলায় অন্য একটি চাকরি করেন, আর সন্ধ্যার পর পার্টটাইম এই কাজটি করেন। এতে তার কিছু বাড়তি আয় হয়।
সানাউল্লাহ শাওন বলেন, "আমাদের হয়ে যারা কাজ করছে, তারা প্রায় সবাই অন্য কোথাও ফুলটাইম কাজ করে। সন্ধ্যার পরের সময়টা কাজে লাগিয়ে তারা এখানে বাড়তি আয় করছে। সকালবেলা আবার অন্য কাজে ফিরে যায়।"
বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে
ঐশিকা জয়া জানান, দুটি মাধ্যমে তারা বিজ্ঞাপন পেয়ে থাকেন। কেউ অনলাইনে কার্যক্রম দেখে যোগাযোগ করেন, আবার কেউ মাঠপর্যায়ে কার্যরত দলের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন।
"আমাদের সুবিধা হলো, আমরা অন্যের পণ্য প্রচারণার পাশাপাশি নিজেদের বিজ্ঞাপনও চালাতে পারি," বলেন তিনি।
হিউম্যান বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দিতে হলে নির্দিষ্ট আকারের ভিডিও বা রিলস জমা দিতে হয়। চাইলে স্থির ছবির মাধ্যমেও বিজ্ঞাপন প্রচার সম্ভব। যেহেতু এটি ডিজিটাল স্ক্রিন, তাই প্রায় সব ধরনের ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট প্রদর্শন করা যায়।
'স্মার্ট স্ক্রিন ডিজিটাল'-এর কার্যালয় তেজগাঁওয়ের নাবিস্কো রোডে। তাদের একটি সক্রিয় ফেসবুক পেজ রয়েছে, যার মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়। এছাড়াও শহরের নির্ধারিত বিভিন্ন স্থানে থাকা তাদের প্রচারণা দলের মাধ্যমেও যোগাযোগের সুযোগ রয়েছে।