‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র’: প্রজন্ম পেরোনো শিল্পযাত্রায় অনন্য যারা

ফরিদপুরের গিরিধরদের একক উদ্যোগে ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে ইতিহাসনির্ভর অনলাইন প্ল্যাটফর্ম 'বাংলাদেশ দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র'। ফেসবুকভিত্তিক এই প্ল্যাটফর্মটি দুষ্প্রাপ্য ছবির মাধ্যমে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। পাশাপাশি তুলে ধরা হয় জাতীয় জীবনের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের পুরোনো, অমূল্য সব মুহূর্ত।
স্ক্রল করতে করতে এই প্ল্যাটফর্মে চোখে পড়ে নামী মানুষের দুর্লভ সব ছবি। তেমনই কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আজকের আয়োজন।
সেলিনা হোসেন ও তার মেয়ে ফারিয়া লারা
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের শৈশব কেটেছে বাবার কর্মস্থল বগুড়ায়। বইয়ের প্রতি টান খুব একটা ছিল না ছোটবেলায়। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়ার সুযোগও হয়নি ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে পর্যন্ত। তবে প্রকৃতি আর মানুষের প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল।
ছোটবেলা থেকেই তিনি বেড়ে ওঠেন মুক্ত পরিবেশে—প্রকৃতি আর মানুষের সাহচর্যে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "আমার শৈশবটি ছিল একটি আশ্চর্য সোনালি শৈশব। এই শৈশবে আমি প্রকৃতি এবং মানুষ দেখেছি। মাঠে-ঘাটে, নদীতে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর এক অবাধ স্বাধীনতা ছিল আমার। আর মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক দেখার সুযোগ হয়েছিল। এই সব কিছুই আমাকে লেখালেখিতে আসার প্রেরণা দিয়েছে।"
তার অন্যতম আলোচিত উপন্যাস 'হাঙর নদী গ্রেনেড', যেটি পরে চলচ্চিত্রে রূপ নেয়, লেখা হয়েছিল যশোরের একটি বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর ১১-এর কাহিনী ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে উপন্যাসটি রচিত হয়। সেক্টর ১১-এর কমান্ডার কর্ণেল তাহের ছিলেন তার খালাত ভাই।
সেলিনা হোসেনের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তার গল্প ও উপন্যাস ইংরেজি, রুশ, মেলে ও কানাড়ি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম.এ পাস করার পরের বছর।
লেখালেখির শুরু অবশ্য আরও আগে—ষাটের দশকের মধ্যভাগে, রাজশাহী মহিলা কলেজে পড়ার সময় থেকেই। কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমিতে গবেষণা সহকারী হিসেবে। পরবর্তীতে বাংলা একাডেমির পরিচালক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান এবং সর্বশেষ বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রথম নারী পরিচালক। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে তিনি সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
তার মেয়ে ফারিয়া লারা ছিলেন দেশের একজন প্রশিক্ষক নারী বৈমানিক। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার পোস্তগোলায় বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। দুর্ঘটনার আগে প্লেন থেকে পাঠানো লারার শেষ বার্তা ছিল— 'পৃথিবীতে আমি আর কয়েক মিনিট বেঁচে আছি।'
লারাও মায়ের মতো প্রকৃতি ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন ঘুরতে আর প্রান্তিক মানুষের জীবনের কাছে যেতে। উপরে সেলিনা হোসেন ও লারার এই দুর্লভ ছবিটি তোলা হয়েছিল বান্দরবনের চিম্বুক পাহাড়ে—লারার মৃত্যুর মাত্র এক মাস আগে।
আফজাল হোসেন
বহু প্রজন্মের কাছে প্রিয় অভিনয়শিল্পী আফজাল হোসেন। পঞ্চম দশকে পা রাখা এই অভিনেতার অভিনয়জীবন শুরু হয় ১৯৭৫ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে স্নাতক শেষে তিনি যোগ দেন 'ঢাকা থিয়েটার'-এ। একই বছরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে অভিনয়ের সুযোগও আসে।
১৯৮০ সালে বিটিভিতে প্রচারিত নাটক 'রক্তের আঙুলতা' দিয়ে দর্শকের নজরে আসেন তিনি। এরপর একে একে জনপ্রিয়তা পান নাট্যজগতে, হয়ে ওঠেন টেলিভিশনের জনপ্রিয় মুখ।
বিশেষ করে ১৯৮৮ সালে হুমায়ূন আহমেদের 'বহুব্রীহি' নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন। তার সঙ্গে সুবর্ণা মুস্তাফার জুটি—'শুধু তোমার জন্যে', 'মন ময়ারি', 'শুধু একবার বলো'—এসব নাটক আজও দর্শকের মনে চিরসবুজ হয়ে আছে।

শুধু অভিনয়েই নয়, নাটক ও টেলিছবি নির্মাণেও সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন ছোটোকাকু নামে পরিচিত এই অভিনেতা। বিগত কয়েক বছরে ওটিটি মাধ্যমেও তার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। 'পেট কাটা ষ' ও 'কারাগার'-এর মতো আলোচিত সিরিজে তার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। পাশাপাশি তিনি মঞ্চনাটকেও সক্রিয়, যুক্ত আছেন চলচ্চিত্র নির্মাণেও।
তবে এখানেই তার শিল্পীজীবনের শেষ নয়। আফজাল হোসেন মূলত একজন চিত্রশিল্পীও। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক ছিল তার। সেই আগ্রহ থেকেই ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। ছাত্রজীবন থেকেই বইয়ের প্রচ্ছদ ও রেখাচিত্র আঁকতেন।
তিনি আলী ইমামের 'চারজন', আবু হাসান শাহরিয়ারের 'পায়ের নূপুর', সিকদার আমিনুল হকের 'পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা', রাবেয়া খাতুনের 'বায়ান্ন গলির এক গলি', সৈয়দ শামসুল হকের 'বারো দিনের শিশু', ইমদাদুল হক মিলনের 'নায়ক'–এসব বইয়ের প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন করেছেন।
বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবেও তিনি সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। পত্রিকা ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন নির্মাণে এনেছেন নতুন ধারার স্পর্শ। পিয়ারসন, প্রাইড, পাকিজা, মানোলা, রেক্সপোন, গোল্ডেন পাফ—এসব ব্র্যান্ডের ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
এছাড়া সাহিত্যচর্চাতেও তার দখল প্রশংসনীয়। ছাত্রজীবন থেকেই কবিতা পড়ার অভ্যাস ছিল। এখন পর্যন্ত তার পাঁচটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। রয়েছে উপন্যাস ও নাট্যগ্রন্থও। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: 'বিরহকাল' (উপন্যাস), 'কানামাছি' (গল্পগ্রন্থ), এবং 'পারলে না রুমকি' (নাটক)।
তারিক আনাম খান
খ্যাতিমান মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অভিনেতা এবং বিজ্ঞাপন নির্মাতা তারিক আনাম খান বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নাম। ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার (এনএসডি) সেরা ছাত্র ছিলেন তিনি। সেই সময় ক্লাসমেট ছিলেন বলিউড অভিনেতা অনুপম খের।
ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে ছিল শিল্পের প্রতি আকর্ষণ। তখন টেলিভিশনের তেমন প্রচলন ছিল না। সাতক্ষীরার বাড়িতে বসে রেডিওতে কলকাতার নাটক-অনুষ্ঠান শুনে গড়ে ওঠে তার আগ্রহ।

তার আরও একটি গর্বের পরিচয়—তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে সেক্টর ৯-এর অধীনে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধকালেও গণনাট্য পরিবেশনা দলের মাধ্যমে নাটক মঞ্চায়ন করে মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করতেন। যুদ্ধ শেষে স্থির করেন, অভিনয়ের মাধ্যমেই দেশের শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। ১৯৭২ সালে ঢাকায় এসে শুরু করেন অভিনয়জীবন।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নাটক, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছেন তিনি। 'মাটির কোলে', 'প্রজাপতি'—এবং বিশেষভাবে 'সংশপ্তক' নাটকটি তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চলচ্চিত্রেও রেখেছেন সমান দক্ষতার স্বাক্ষর। অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে—ঘুড্ডি, সুরুজ মিয়া, জয়যাত্রা, মেড ইন বাংলাদেশ, আহা!, দ্য লাস্ট ঠাকুর, জাগো, ঘেটুপুত্র কমলা, জোনাকীর আলো, দেশা—দ্য লিডার।
অভিনয়ে তিনি সবসময় বেছে বেছে কাজ করতে পছন্দ করেন। তাই সমসাময়িক অনেক অভিনেতার চেয়ে তার অভিনয়ের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও, প্রতিটি কাজেই ছিল দক্ষতার ছাপ।
১৯৮৫ সালে 'অ্যাডশপ' নামে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে বিপণন জগতে যুক্ত হন। পাশাপাশি ১৯৯০ সালে গঠন করেন নাট্যদল 'নাট্যকেন্দ্র', যা আধুনিক বাংলা নাট্যচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এই দল থেকেই উঠে এসেছেন জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, তৌকীর আহমেদের মতো জনপ্রিয় অভিনেতারা।
সাম্প্রতিক সময়েও তিনি থেমে নেই। শাকিব খানের বিপরীতে 'রাজকুমার' সিনেমায় অভিনয় করেছেন বাবার চরিত্রে। ওয়েব সিরিজ 'ফেউ' এবং নাটক 'সুখ অসুখ'–এও দেখা গেছে তাকে। শিগগিরই নতুন একটি নাটকের শুটিংয়ে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
২০১৫ সালে হলিউডের 'Avengers: Age of Ultron' সিনেমার বাংলাদেশ ইউনিটে প্রডাকশন সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেন। ২০২৪ সালে অভিনয়শিল্পী সংঘ-এর জরুরি সাধারণ সভায় তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সংস্কার কমিটির সভাপতি মনোনীত করা হয়।
ছয় ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার এই অভিনেতার ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। ব্যক্তিজীবনে ১৯৮৫ সালে তিনি অভিনেত্রী ও নির্মাতা নিমা রহমান-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের একমাত্র ছেলে আরিক আনাম খান একজন থিয়েটার নির্দেশক হিসেবে কাজ করছেন।
সুবর্ণা মুস্তাফা
আশির দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় টেলিভিশন অভিনেত্রীদের একজন সুবর্ণা মুস্তাফা। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি অভিনয়ের জগতে নিজের মুগ্ধতাদায়ক উপস্থিতি ধরে রেখেছেন। তিনি একাধারে অভিনেত্রী, নির্মাতা, আবৃত্তিশিল্পী ও উপস্থাপক।
প্রখ্যাত অভিনেতা গোলাম মুস্তাফার মেয়ে সুবর্ণা মুস্তাফার জন্ম ১৯৫৯ সালের ২ ডিসেম্বর, ঢাকায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। বাবা ও মায়ের সাংস্কৃতিক পরিবেশেই বড় হয়েছেন তিনি। তার মা ছিলেন পাকিস্তান রেডিওর প্রযোজক। মাত্র পাঁচ-ছয় বছর বয়সে রেডিও নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত শিশুশিল্পী হিসেবে নিয়মিত টিভিতে কাজ করতেন সুবর্ণা।
১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর পরিচালনায় 'ঘুড্ডি' সিনেমার মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে। এরপর 'লাল সবুজের পালা', 'নতুন বউ', 'নয়নের আলো', 'সুরুজ মিয়া', 'শঙ্খনীল কারাগার', 'রাক্ষস', 'অপহরণ', 'স্ত্রী', 'দূরত্ব'–সহ একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
১৯৯০ সালে বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদের নাটক 'কোথাও কেউ নেই'-তে অভিনয় করে সব মহলের প্রশংসা কুড়ান খ্যাতনামা এই শিল্পী । পরে 'আজ রবিবার' সহ আরও অনেক নাটকে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কাজ করেন।
টেলিভিশন বিজ্ঞাপনেও ছিল তার সরব উপস্থিতি—বিশেষ করে লাক্স সাবানের মডেল হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান।
তার একটি ব্যতিক্রমী পরিচয়—তিনি একজন সাবেক সংসদ সদস্য। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন-৪ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ
'আলোকিত মানুষ চাই'—এই মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের বই পড়া আন্দোলনের পথিকৃৎ হয়ে উঠেছেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, যার মাধ্যমে তিনি হাজার হাজার স্কুলপড়ুয়াকে বই পড়ার অভ্যাসে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
এই কেন্দ্রের 'আলোর স্কুল' কর্মসূচি দেশের প্রতিটি প্রান্তে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে।
শুধু পাঠাভ্যাস নয়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছিলেন জনপ্রিয় উপস্থাপক। রসবোধ, কৌতুক, আবৃত্তিশক্তি, দেশপ্রেম ও অসাধারণ বাগ্মিতার জন্য তিনি সমসাময়িকদের থেকে আলাদা হয়ে উঠেছিলেন।

ষাটের দশকে যে আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয়, তার নেতৃত্বে ছিলেন তিনিই। তার সম্পাদিত সাহিত্যপত্রিকা 'কণ্ঠস্বর' হয়ে ওঠে নতুন ধারার সেই সাহিত্যচর্চার অন্যতম রূপকার। কণ্ঠস্বর শুধু একটি পত্রিকা নয়, হয়ে ওঠে একটি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু—বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্যপত্রিকাগুলোর একটি।
ঢিলেঢালা খদ্দরের পাঞ্জাবি–পায়জামায় অভ্যস্ত এই ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৯৩৯ সালের (কিছু মতে ১৯৪০) ২৫ জুলাই, কলকাতার পার্ক সার্কাসে। তার পৈত্রিক নিবাস বাগেরহাটে।
পেশাগত জীবনে ছিলেন শিক্ষক। দেশের নানা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন—মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ, সিলেট মহিলা কলেজ, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, রাজশাহী কলেজ, বুয়েট ও ঢাকা কলেজ–এর মতো প্রতিষ্ঠানে। তবে তিনি কখনোই প্রচলিত অর্থে 'শুধু পাঠ্যবইয়ের শিক্ষক' ছিলেন না।
তার ক্লাসে এমনভাবে পাঠদান হতো যে, অন্য কলেজের ছাত্ররাও শুধু তার ক্লাস করার জন্য ছুটে যেতেন ঢাকা কলেজে।
ডলি জহুর
আসল নাম হামিদা বানু, কিন্তু অভিনয়জগতে তিনি পরিচিত ডলি জহুর নামে। জন্ম ১৯৫৩ সালের ১৭ জুলাই, ঢাকার ভূতের গলিতে। যদিও তার পৈতৃক ভিটা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, শৈশব-কৈশোর কেটেছে ঢাকাতেই।
পড়াশোনা করেছেন আজিমপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে, এরপর ইডেন কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি একাধারে মঞ্চ, বেতার, টিভি ও চলচ্চিত্রে সক্রিয় ছিলেন। নাটকের চিত্রনাট্যও করেছেন।

বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভির তালিকাভুক্ত অভিনয়শিল্পী হিসেবে দ্রুতই সুনাম অর্জন করেন। তার স্বামী জহুরুল ইসলাম-ও ছিলেন একজন পরিচিত অভিনেতা; নাটক ও বিজ্ঞাপনে নিয়মিত অভিনয় করতেন।
নব্বইয়ের দশকে ঢাকাই চলচ্চিত্রে মা চরিত্রে তিনি ছিলেন প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন দুইবার, আর সারা জীবনের অবদানের জন্য ২০২১ সালে পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা।
তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে—'আগুনের পরশমণি', 'শঙ্খনীল কারাগার', 'ঘানি', 'রং নম্বর', 'দারুচিনি দ্বীপ', 'সন্তান যখন শত্রু', 'বাবা কেন চাকর'।
এরমধ্যে 'শঙ্খনীল কারাগার' ছবির জন্যই তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে—'এইসব দিনরাত্রি', 'অক্টোপাস', 'সুখের উপমা', 'আন্তরিক', 'একদিন হঠাৎ', 'শেষ পত্র', 'চুপি চুপি', 'ক্ষণিকালয়'।
নায়ক আলমগীর
নায়ক আলমগীর ঢাকাই চলচ্চিত্রের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। ১৯৭২ সালের ২৪ জুন 'আমার জন্মভূমি' ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে তার। শুরুতে কয়েক বছর অতিবাহিত হয় অপেক্ষা আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
১৯৮০ সালে দিলীপ বিশ্বাসের 'জিঞ্জির' ও আমজাদ হোসেনের 'কসাই' ছবির মাধ্যমে দর্শকের দৃষ্টি কাড়েন। তবে 'নায়ক আলমগীর' হয়ে ওঠা আরও পরে; ১৯৮২ সালে সুভাষ দত্তের 'সবুজ সাথী' ও আমজাদ হোসেনের 'ভাত দে' ছবির মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন নায়ক আলমগীর।
'ভাত দে' ও 'সখিনার যুদ্ধ' ছবিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন শাবানা। সেই থেকে শুরু হয় দর্শকনন্দিত আলমগীর-শাবানা জুটি; একসঙ্গে তারা অভিনয় করেছেন প্রায় ১২০টি ছবিতে।
চার দশকের অভিনয়জীবনে আলমগীর কাজ করেছেন প্রায় ২৩০টি চলচ্চিত্রে।

পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৮৫ সালে 'নিষ্পাপ' ছবির মাধ্যমে। এছাড়া 'মায়ের দোয়া' সহ বেশ কিছু ছবি প্রযোজনাও করেছেন।
নব্বই দশক ও পরবর্তী সময়ে তিনি সফলভাবে কাজ করেন চরিত্রাভিনেতা হিসেবে—'সত্যের মৃত্যু নেই', 'মায়ের অধিকার', 'সুখের ঘরে দুঃখের আগুন', 'মিলন হবে কত দিনে', 'লাট সাহেবের মেয়ে', 'আমি সেই মেয়ে', 'বাপের টাকা', 'শেষ বংশধর', 'টাকা' ইত্যাদি ছবিতে দর্শক হৃদয়ে জায়গা করে নেন, বিশেষ করে ঢাকাই চলচ্চিত্রে বাবা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে।
তার পিতা কলিম উদ্দিন আহম্মেদ ওরফে দুদু মিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র 'মুখ ও মুখোশ'-এর অন্যতম প্রযোজক। মা ছিলেন গৃহিণী। পরিবারের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও রূপালি পর্দায় আসেন আলমগীর।
আজ তিনি ঢাকাই চলচ্চিত্রের অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছেন—৯ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং আজীবন সম্মাননা পদক পেয়েছেন।
দিলারা জামান
দিলারা জামান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। দেশভাগের পর পরিবারসহ চলে আসেন যশোরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, এরপর ইডেন মহিলা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ফখরুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন তার স্বামী। দুই কন্যার একজন আইনজীবী ও অপরজন চিকিৎসক।

ষাটের দশকে ইডেন কলেজে পড়াকালীন মঞ্চনাটকের মাধ্যমে অভিনয়ে যুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে 'ত্রিধারা' নাটকের মাধ্যমে টেলিভিশনে অভিষেক ঘটে তার। এরপর একে একে অভিনয় করেন—'সকাল সন্ধ্যা', 'এইসব দিনরাত্রি', 'সংশপ্তক', 'অয়োময়', 'নক্ষত্রের রাত', 'রূপনগর', 'একান্নবর্তী', 'অবিজ্ঞান', 'সাত চার দুই', 'ওইজা বোর্ড', 'আজ আমাদের ছুটি', 'হিমু', 'উচ্চ মাধ্যমিক পরিবার'–সহ অসংখ্য নাটকে।
পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও রেখেছেন অভিনয়ের ছাপ। অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে—'চাকা', 'আগুনের পরশমণি', 'ব্যাচেলর', 'মেড ইন বাংলাদেশ', 'চন্দ্রগ্রহণ', 'প্রিয়তমেষু', 'মনপুরা', 'বৃহন্নলা', 'হলাদার'।
শুধু অভিনেত্রী নন, তিনি দীর্ঘ ২৬ বছর শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে বয়স আশির ঘরে পা দিয়েও কখনো গয়নায়, কখনো শাড়িতে বা লিপস্টিকে মডেল হয়ে নতুনরূপে দর্শকদের চমকে দিচ্ছেন।
রুনা লায়লা
রুনা লায়লা—বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের সংগীতাঙ্গনের এক কিংবদন্তি। চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক, আধুনিক গান এবং পপ সংগীত–সব শাখাতেই অসামান্য অবদান রেখেছেন।
১৯৫২ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ এমদাদ আলী ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, মা আমিনা লায়লা ছিলেন সংগীতশিল্পী। বাবার বদলির সুবাদে আড়াই বছর বয়সে পাকিস্তানের মুলতানে চলে যান। ছোটবেলা থেকেই সংগীতে হাতেখড়ি। ওস্তাদ হাবিব উদ্দিন আহমেদ ও আবদুল কাদেরের কাছে শিখেছেন শাস্ত্রীয় সংগীত। পণ্ডিত গোলাম কাদিরের কাছে গজলের দীক্ষাও নিয়েছেন।

মাত্র ৬ বছর বয়সে দর্শকের সামনে গান গাওয়া শুরু করেন, এবং ১১ বছর বয়সে করাচির 'জুগনু' সিনেমায় প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে।
বাংলা সিনেমায় প্রথম গান করেন ১৯৭০ সালে, নজরুল ইসলামের 'স্বরলিপি' চলচ্চিত্রে। বলিউডে সংগীত পরিচালক কল্যাণজি-আনন্দজির সঙ্গে প্রথম কাজ করেন 'এক সে বাড়কার এক' ছবিতে। এই গানের রেকর্ডিংয়ে উপস্থিত ছিলেন লতা মুঙ্গেশকর, যিনি তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন এবং পরে প্রতি জন্মদিনে শাড়ি পাঠাতেন।
রুনা লায়লা গেয়েছেন ১৮টি ভাষায়, ১০,০০০-এরও বেশি গান। তার অ্যালবাম 'লিজেন্ডস ফরেভার'-এ গান গেয়েছেন আশা ভোঁসলে, হরিহরণ, আদনান সামি, রাহাত ফতেহ আলী খানের মতো কিংবদন্তীরাও।
ফেরদৌসী মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার ও ত্রপা মজুমদার
বরিশালে জন্ম হলেও অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার বড় হয়েছেন ঢাকায়। তার বাবা ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এবং ১৪ ভাইবোনের মধ্যে তার মেজ ভাই ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী।
ভাইয়ের লেখা নাটক 'একতলা দোতলা' দিয়ে টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন। মঞ্চে প্রথম অভিনয় করেন রোবট চরিত্রে। তার জনপ্রিয় নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে—'কোকিলারা', 'সংশপ্তক'-এর হুরমতি, 'সারেং' (বেতার নাটক) ইত্যাদি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রায় ৩০০ নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যচর্চা করতে গিয়ে পরিচয় হয় খ্যাতিমান অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার-এর সঙ্গে। পরে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

রামেন্দু মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪১ সালের ৯ আগস্ট, লক্ষ্মীপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। অধ্যাপনার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন ও বিজ্ঞাপন জগতে সক্রিয় হন। তিনি 'মজুমদার থিয়েটার' নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমানে আন্তর্জাতিক নাট্য সংগঠন আইটিআই-এর অনারারি প্রেসিডেন্ট (দ্বিতীয় এশীয় প্রতিনিধি)।
এই দম্পতির একমাত্র কন্যা ত্রপা মজুমদার একজন গুণী অভিনয়শিল্পী। একসময় নিয়মিত ছিলেন টিভি নাটকে। এখন ব্যস্ত আছেন পারিবারিক বিজ্ঞাপন সংস্থায় এবং থিয়েটার কর্মকাণ্ডে। পাশাপাশি খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সম্প্রতি তিনি অভিনয় করেছেন বিঞ্জ প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত '৯ এপ্রিল' (২০২২) ওয়েব সিরিজে এবং বিজয় দিবস উপলক্ষে বিটিভিতে প্রচারিত 'তাহাদের সন্ধানে' নাটকে (২০২৩)।
ছবি কৃতজ্ঞতা: বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র