‘আমাদের সমস্যা তো চীন এসে ঠিক করে দেবে না’: বুয়েট শিক্ষকদের ডিজাইনে নিরাপদ অটোরিকশা
'রিকশায় চড়লে পাশটা শক্ত করে ধরে রাখবে, পা দিয়ে সামনের দিকটা চেপে ধরবে। আর উঁচুনিচু রাস্তা হলে একটু উঁচু হয়ে ব্যালেন্স করবে!' ছোটবেলায় বাবা-মায়ের এই সাবধানবাণী শুনে শুনেই রিকশায় চড়া রপ্ত করতে হয়েছিল তাকে। পরে নিজের ছেলে-মেয়েকেও শিখিয়েছেন এই টোটকা। যেন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হওয়া কোনো অদৃশ্য শিক্ষা—যার না আছে কোনো বই, না কোনো পাঠ্যক্রম; তবু ভীষণ জরুরি।
তবে শৈশব থেকেই একটি প্রশ্ন বারবার উঁকি দিতো মনে—'রিকশায় চড়া শিখতে হবে কেন? পৃথিবীর আর কোথাও কি কোনো যানবাহনে চড়তে শেখার দরকার হয়?'
এই ভাবনাই বারবার ঘুরপাক খেতো অধ্যাপক ড. মো. এহসানের মনে। তিনি বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক। সম্প্রতি তিনি ছয় সদস্যের একটি দল নিয়ে সেই শৈশবের প্রশ্নটিরই উত্তর খুঁজেছেন। তৈরি করেছেন নিরাপদ অটোরিকশা—যা অন্তত কিছুটা হলেও নিশ্চিত করতে পারে নাগরিকদের দুশ্চিন্তাহীন যাত্রা।
ঢাকায় দুধরনের রিকশা চলে—পায়ে-চালিত প্যাডেল রিকশা ও ব্যাটারি-চালিত অটোরিকশা। সাধারণত প্যাডেল রিকশায় ব্যাটারি ও মোটর সংযুক্ত করে তৈরি করা হয় এই অটোরিকশা। এতে গতি যেমন বাড়ে, দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বেড়ে যায় বহুগুণে। বারবার উদ্যোগ নিয়েও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি এসব যানবাহন। সরকারও খুঁজছিল একটি স্থায়ী সমাধান। সেই সমাধানই নিয়ে এসেছে বুয়েটের এই গবেষণা দল।
এই প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক এহসান। বললেন, '২০০৪-০৫ সালের দিকে চীন থেকে অটোরিকশা আমদানি শুরু হয়। ধীরে ধীরে এখানেই গড়ে ওঠে ইন্ডাস্ট্রি। তখন থেকেই যার যার মতো করে গাড়ি তৈরি করতে থাকে সবাই। আমরা বিভিন্ন সময়ে সরকারকে বলে আসছিলাম এই গাড়িগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড রূপ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় আনতে।'
২০২০ সালে সরকার বুয়েটকে একটি চিঠি পাঠায়। তাতেই ছিল সেই বহুপ্রতীক্ষিত প্রস্তাব—অটোরিকশার একটি আদর্শ সংস্করণ তৈরির আগ্রহ। অধ্যাপক এহসান বললেন, 'তখন আমরা প্রস্তাবটি গ্রহণ করি। বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের অধীনে ২০২০ সালে একটি গবেষণা প্রকল্পের প্রস্তাব আসে। বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষক মিলে আমরা একটি দল গঠন করি। ২০২১ সালে আমাদের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এরপর ছয়জনের দলটি কাজ শুরু করে।'
শুরুর আগে...
ব্যাটারি-চালিত অটোরিকশার অনেক সুবিধা আছে—এটি সরাসরি পরিবেশ দূষণ করে না, শব্দ কম হয়, চালানোর খরচও অনেক কম। কিলোমিটারপ্রতি খরচ মাত্র দুই থেকে আড়াই টাকা। তাহলে সমস্যা কোথায়?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গবেষণার প্রাথমিক ধাপে অটোরিকশা ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু দেখা গেল, এই বিষয়ে স্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য তথ্য খুব একটা নেই। ফলে পরিকল্পনা ছাড়াই করতে হয় মাঠপর্যায়ের জরিপ।
অধ্যাপক এহসান জানালেন, 'প্রথম ছয় মাস আমরা সারাদেশে ঘুরে বেড়িয়েছি। নানান প্রান্তে অটোরিকশায় চড়েছি, রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা বলেছি। এভাবে ঘুরে ঘুরেই জানতে পেরেছি, সারা দেশে প্রায় ১০-১১ ধরনের ইজিবাইক বিভিন্ন কারখানায় তৈরি হচ্ছে। সেখান থেকেই এসব বাইকের সমস্যাগুলো আমাদের নজরে আসে।'
ছয় মাসে চোখে পড়েছে বিচিত্র সব চিত্র—শীতকালে কাপড় দিয়ে মোড়ানো গাড়ি, আয়নার বদলে পলিথিন, ছাদহীন রিকশা। অধ্যাপক এহসান বললেন, 'প্রথমে ভাবতাম, হয়তো কাচ ভেঙে গেছে, তাই লাগানো হয়নি। পরে দেখি, বহু কারখানাই পলিথিন দিয়েই প্রডাকশন করে, ছাদহীন গাড়ি বানায়। সবই সম্ভব হচ্ছে!'
আরও বলেন, 'দেখলাম, গাড়ির মালিক আসলে কোনো ধনী ব্যক্তি, গরিব ড্রাইভার সেটা ভাড়ায় চালায়। ধনী কেউ একজন শুধু মুনাফা করছে।'
সবকিছু পর্যবেক্ষণের পর অধ্যাপক এহসান ও তার দলের মনে হলো, সবাই কেবল উৎপাদন খরচ কমানোর দিকেই মনোযোগী—যাত্রী কিংবা চালকের নিরাপত্তার দিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। ঢাকায় তো পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। হালকা কাঠামোর রিকশায় ব্যাটারি ও মোটর বসিয়ে বানানো হচ্ছে বৈদ্যুতিক গাড়ি—ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। রিকশা যত সস্তা, মুনাফা তত বেশি—এই দৃষ্টিভঙ্গিই চালু। তাই বুয়েটের দলটি ভাবলো, এমন কিছু কি করা যায়, যাতে রিকশার দাম আগের মতোই থাকে, কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়? সেই ভাবনা থেকেই শুরু হয় প্রকল্পের কাজ।
এই দলে আরও ছিলেন যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম আকন্দ ও ড. মো. আমান উদ্দীন, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিয়াউর রহমান খান এবং গবেষণা প্রকৌশলী হিসেবে মো. আসাদুজ্জামান ও আবদুল আজিজ ভুঁইয়া।
সমস্যা ধরে ধরে সমাধান
প্যাডেল রিকশার সর্বোচ্চ গতি কত? ১০ কিলোমিটার বা তার কাছাকাছি। কিন্তু একই রিকশায় যখন মোটর যুক্ত করা হয়, তখন তার গতি বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ কিলোমিটার! তখন তাকে রুখবে কে?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই যান চালাচ্ছে অল্পবয়সি কিশোর চালক। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে তাই দুর্ঘটনা ঘটবে না, এমনটা ভাবার অবকাশ নেই।
প্রশ্নগুলো করেছিলেন ড. এহসান। জানালেন, এমনই নানা প্রশ্ন থেকেই সমাধানে পৌঁছাতে হয়েছে তাদের। দীর্ঘ অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিজের তৈরি অটোরিকশা মডেলে এনেছেন মোট ১৬টি পরিবর্তন। আশা করছেন, এসব পরিবর্তনের ফলে মিলবে অনেকটাই ইতিবাচক ফলাফল।
তা কী কী পরিবর্তন এসেছে নতুন এ ডিজাইনে?
নতুন অটোরিকশার দৈর্ঘ্য ৩.২ মিটার, প্রস্থ ১.৫ মিটার এবং উচ্চতা ২.১ মিটার। রিকশাটি ৩২৫ থেকে ৪২৫ কেজি পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারবে। আকারে বাজারের অন্যান্য অটোরিকশার মতোই, তবে যাত্রীসংখ্যায় বড় পরিবর্তন—এতে উঠতে পারবেন সর্বোচ্চ দু'জন যাত্রী। এতে আকার ও ওজনের ভারসাম্য রক্ষা পাবে, ফলে বাহনটি সহজে উল্টে যাবে না বলে জানালেন অধ্যাপক এহসান।
ভারসাম্যের পাশাপাশি ব্রেকিং ব্যবস্থাতেও আনা হয়েছে উন্নয়ন। তিনটি চাকাতেই যুক্ত করা হয়েছে 'হাইড্রোলিক ডিস্ক ব্রেক' ও 'পার্কিং ব্রেক'। এতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বেড়েছে অনেক গুণ। 'লুকিং গ্লাস', সামনে-পেছনে 'ইন্ডিকেটর লাইট'—সবই থাকছে নতুন রিকশাটিতে।
অধ্যাপক এহসান বলেন, 'এখনকার প্যাডেল রিকশায় যখন মোটর লাগানো হয়, তখন তার গতি সাধারণ ব্রেক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এজন্যই দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের ডিজাইনে গতির সঙ্গে ব্রেক, চাকা, আকার এবং ওজনের ভারসাম্য রাখা হয়েছে। সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলবে এ রিকশা।' রিকশাচালক ও যাত্রীদের কথা ভেবে গাড়িটিতে থাকছে উন্নতমানের ছাউনি ও হেডলাইট এবং কাচের 'উইন্ডশিল্ড'।
আগের খরচেই উৎপাদন
অটোরিকশার ডিজাইন তৈরির সময় থেকেই দেশের বিভিন্ন কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করেছেন বুয়েটের গবেষকরা। লক্ষ্য ছিল—দেশীয় কারখানাগুলো যেন সহজেই এই নকশায় গাড়ি তৈরি করতে পারে। সেজন্য কিছু পরিকল্পনা বাদ দিয়েও শেষ পর্যন্ত এমন একটি ডিজাইন দাঁড় করানো হয়েছে, যা অন্তত ১০–১৫টি দেশীয় কারখানা এখনই উৎপাদন করতে সক্ষম।
শুধু তা-ই নয়, খরচও পড়বে আগের মতোই।
অধ্যাপক এহসান বলেন, 'আমরা এমন কোনো ডিজাইন করতে পারি না যেটা দেশের ইন্ডাস্ট্রি বানাতে পারবে না। বিদেশ থেকে তৈরি করিয়ে আনলে দাম বেড়ে যাবে। তাই আমাদের দেশের সক্ষমতার কথা মাথায় রেখেই ডিজাইন করতে হয়েছে। ব্যাটারির দাম নির্ধারিত—৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। বাকি খরচ কাঠামোর। সব মিলিয়ে দেড় লাখ টাকায় পুরো গাড়ি তৈরি করা সম্ভব।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের সমস্যা তো চীন এসে ঠিক করে দিয়ে যাবে না। আমাদের নিজেদেরই ইন্ডাস্ট্রিকে সক্ষম করে তুলতে হবে।'
তবে এসব কাজের জন্য কম ভোগান্তি পোহাতে হয়নি তাকে। 'বুয়েটের শিক্ষক রিকশা বানাচ্ছেন'—এমন কটাক্ষ শুনতে হয়েছে বারবার। 'শিক্ষকতা বাদ দিয়ে রিকশা তৈরি করছেন'—এসব কথাও কেউ কেউ ছুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু এসব কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে নিজের কাজে অটল থেকেছেন তিনি। বলেছেন, রিকশা নিয়ে কাজ করলে হীনমন্যতায় ভোগার কিছু নেই। দেশের প্রয়োজনেই তারা এগিয়ে এসেছেন। বরং আরও আগেই এমন উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল বলে মত তার।
বুয়েটের তৈরি এ রিকশার সক্ষমতাও যথেষ্ট। একবার চার্জ দিলে অন্তত ১২০ কিলোমিটার চলতে পারবে বাহনটি। আগের দামে আরও উন্নতমানের অটোরিকশা দিতে পারবে দেশীয় ইন্ডাস্ট্রি—এমনটাই আশা করছেন গবেষকেরা।
আপাতত ঢাকা শহরেই চলবে
২০২২ সালের ডিসেম্বরে বুয়েটের তৈরি অটোরিকশার শারীরিক কাঠামো তৈরি হয়। পরের বছরের জানুয়ারি থেকেই বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে তা প্রদর্শন করতে থাকেন প্রকৌশলী দলটি।
'বিভিন্ন সরকারি মন্ত্রণালয়ে দেখিয়েছি, বিইপিআরসি অনেক জায়গায় প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে, তৎকালীন বিদ্যুৎ উপদেষ্টাকেও দেখানো হয়েছে। সবাই ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। কিন্তু তারপর, যে কারণেই হোক, সরকার আর এগিয়ে আসেনি,' বলেন তিনি।
'এরই মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকার সড়কে কিছুটা পরিবর্তন আসে। প্যাডেলচালিত রিকশাতেও মোটর লাগানো শুরু হয়। তখন সরকার আবার আমাদের ডাকে', বললেন অধ্যাপক এহসান। আশা প্রকাশ করেন, এবার কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তবে আপাতত শুধু ঢাকা শহরের জন্যই এ পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে সরকার। ধীরে ধীরে তা সারাদেশে সম্প্রসারণের লক্ষ্য রয়েছে। এই নতুন রিকশার জন্য আলাদা লাইসেন্সও নিতে হবে, জানালেন ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।
তিনি বলেন, 'ধাপে ধাপে ঢাকার রাস্তা থেকে সব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা উঠিয়ে সরকার অনুমোদিত নতুন অটোরিকশা নামানো হবে। সেগুলো চালাতে চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এনআইডি দিয়ে চালকদের লাইসেন্স নিতে হবে।'
ড. মো. এহসান জানালেন, আপাতত নতুন অটোরিকশার ডিজাইনটির সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। সরকারকে বেশ কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে খুব শিগগিরই ঢাকার রাস্তায় দেখা যেতে পারে বুয়েটের তৈরি অটোরিকশা। আর অধ্যাপক এহসানের আশা, এতে অন্তত কিছুটা হলেও নিরাপদ হয়ে উঠবে ঢাকার রাস্তা।
ছবি: জুনায়েত রাসেল/টিবিএস