‘বাংলা টেসলা’র দৌরাত্ম্যে ঢাকায় বছরে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ চুরি
কার্যকর গণপরিবহন না থাকায় রাজধানীতে অটোরিকশা হয়ে উঠেছে যাতায়াতের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। তবে বেপরোয়া চালকদের কারণে সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও তীব্র যানজট। ফলে অননুমোদিত এ যানবাহনের বিরুদ্ধে ক্ষোভও বাড়ছে বহু মানুষের মনে।
তবে নীরবে, কিন্তু দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়া অবৈধ চার্জিং কেন্দ্রগুলো ব্যাটারিচালিত এসব রিকশাকে টিকিয়ে রাখছে, আর এতে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
বারবার অভিযানের পরও অননুমোদিত চার্জিং স্টেশন ও অস্থায়ী গ্যারাজের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এতে রাজধানীর রাস্তায় চলা আনুমানিক ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশার অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে।
রাজধানীতে বিআরটিএ বা সিটি করপোরেশনসহ কোনো সরকারি সংস্থার কাছে ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন সম্ভব না হলেও, এসব যানবাহনের ব্যাটারি চার্জিংয়ের অনুমতি দিয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়।
এ ধরনের প্রায় ৩ হাজার ৩০০ চার্জিং স্টেশনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে শুধু ডিপিডিসির আওতায়ই রয়েছে প্রায় ২ হাজার ১০০টি।
সরকার বৈদ্যুতিক যান চার্জিং স্টেশনের জন্য ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করেছে ১০ টাকা। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য চার্জিং পয়েন্ট, যেখানে বৈধ সংযোগ ব্যবহার করেই ব্যাটারিচালিত অননুমোদিত রিকশার বিস্তারকে আরও উসকে দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তালিকা অনুযায়ী, রাজধানীর ১০টি ক্রাইম বিভাগের মধ্যে ৮টিতে রয়েছে ৩ হাজার ৩০০ বৈধ চার্জিং স্টেশন, ৪৮ হাজার ১৩৬টি অবৈধ চার্জিং পয়েন্ট এবং ৯৯২টি গ্যারাজ। এসব গ্যারাজেও ব্যাটারি চার্জিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
মিরপুর বিভাগেই সাতটি থানার আওতায় রয়েছে ৩ হাজার ৯৮৩টি চার্জিং পয়েন্ট এবং ২৫৯টি গ্যারাজ। ওয়ারি বিভাগে রয়েছে ৩ হাজার ৫১৬টি চার্জিং পয়েন্ট ও ১৩৬টি গ্যারাজ। গুলশান বিভাগে ২ হাজার ৬৪৩টি চার্জিং পয়েন্ট ও ১২৮টি গ্যারাজ। উত্তরা বিভাগে রয়েছে ১ হাজার ৩০৫টি চার্জিং পয়েন্ট এবং ৭২টি গ্যারাজ।
এ ছাড়া মতিঝিল বিভাগে ১ হাজার ৩৯০টি চার্জিং পয়েন্ট ও ৬০টি গ্যারাজ, লালবাগ বিভাগে ১৯৯টি চার্জিং পয়েন্ট ও ৭৭টি গ্যারাজ রয়েছে। তেজগাঁও বিভাগে ২৩৪টি এবং রমনা বিভাগে ২৬টি অবৈধ গ্যারাজ শনাক্ত করেছে পুলিশ।
একসময় অল্প খরচে চলাচলের সহজ মাধ্যম হিসেবে যে ব্যাটারিচালিত রিকশার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এখন রূপ নিয়েছে এক বিদ্যুৎ চুরির বাজারে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে শত শত গ্যারাজে মেইন বিদ্যুৎ লাইন কিংবা স্ট্রিটলাইট লাইন থেকে অবৈধ সংযোগ নিয়ে রাতের বেলায় রিকশাপ্রতি ১০০–১৫০ টাকায় চার্জিংয়ের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
প্রতি বছর ঢাকার অননুমোদিত ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর চার্জিং বাবদ লেনদেন হয় আনুমানিক ৪ হাজার কোটি টাকা। গ্যারাজ মালিকদের জন্য এটি যেমন লাভজনক ব্যবসা, সরকারের জন্য তেমনি ব্যাপক মাত্রার নজরবিহীন বিদ্যুৎ চুরি।
যদিও কিছু গ্যারাজ অনুমোদিত গ্রিড সংযোগের মাধ্যমে চার্জিং সুবিধা দিচ্ছে। তবে অনেকেই এসব বৈধ সংযোগের আড়ালে অবৈধ চার্জিং ব্যবসা চালাচ্ছেন বলে উঠে এসেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনুসন্ধানে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বলছে, মিটার ব্যবহার করুক কিংবা অননুমোদিত সংযোগে চলুক শহরের প্রায় সব বৈদ্যুতিক রিকশা চার্জিং স্টেশনই অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি—ডেসকো—বিদ্যমান বিধি লঙ্ঘন করে যথাযথ যাচাই–বাছাই ছাড়াই আবাসিক এলাকায় অনেক চার্জিং স্টেশনকে বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে।
রাজধানীর শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০, পল্লবী, রূপনগর, কালশি, ভাটারা, নতুনবাজার, কল্যাণপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মালিবাগ, রামপুরা, খিলগাঁও, লালবাগ, চকবাজার ও বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে অবৈধ চার্জিং পয়েন্টগুলোর বাস্তব চিত্র দেখা গেছে। কোনো গ্যারাজ বা চার্জিং স্টেশনেই নেই ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্যাটারিচালিত তিনচাকার গাড়ির বিষয়ে স্পষ্ট জাতীয় নীতিমালা না থাকায় বর্তমান এই সংকট তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, রাজধানীতে এসব অটোরিকশাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে ঢাকার পুরো পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এ পরিস্থিতি ঠেকাতে প্রথমেই সব অনিয়ন্ত্রিত যান তৈরির কেন্দ্র ও চার্জিং স্টেশনগুলো বন্ধ করতে হবে।
অবৈধ চার্জিংয়ের জমজমাট ব্যবসা
মিরপুরের পশ্চিম কাজীপাড়ায় একটি সঙ্কীর্ণ গ্যারাজে সারি বেঁধে রাখা ছিল প্রায় ৫৫টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এর মধ্যে ১৪টি গ্যারাজ মালিকের, বাকিগুলো দৈনিক ভাড়া ও চার্জিং ফি দিয়ে এখানে রাখা হয়।
গ্যারাজের মেকানিক তসলিম হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গ্যারাজটির দৈনিক বিদ্যুৎ বিল প্রায় ২ হাজার ৫০০ টাকা।
"এটা আগে প্যাডেল রিকশার গ্যারাজ ছিল। গত বছরের ৫ আগস্টের পর সবাই অটোরিকশায় চলে এসেছে। আশপাশে আরও কয়েকটি গ্যারাজ একইভাবে চলছে," বলেন তিনি।
এই চার্জিং নেটওয়ার্ককে টিকিয়ে রেখেছেন চালকেরা—যাদের অনেকেই দেশের বিভিন্ন জেলা ও গ্রামাঞ্চল থেকে ঢাকায় এসে অটোরিকশাচালক হয়েছেন।
ভোলা থেকে আসা চালক মুনা টিবিএসকে বলেন, "আমি এখান থেকে রিকশা ভাড়া নেই। এখন চারদিকে শুধু অটোরিকশা। সবাই এই ব্যবসাই করছে।"
রাস্তা এগোতেই প্রায় ৫০০ মিটার দূরে দেখা যায় আরও একটি বিশাল গ্যারাজ। এখানে রয়েছে প্রায় ১০০টি ব্যাটারিচালিত রিকশা।
গ্যারাজটি পরিচালনা করেন আবদুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, "আমাদের সব রিকশাই ভাড়ায় চলে, বিভিন্ন মালিকের। দৈনিক বিদ্যুৎ খরচ প্রায় ৪ হাজার ৫০০ টাকা। এখন আয় কমে গেছে, কারণ চারদিকে এখন অনেক গ্যারাজ।"
তাদের হিসাবে, একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা সম্পূর্ণ চার্জ দিতে খরচ হয় প্রায় ৭০–১০০ টাকা। যদি দৈনিক বিদ্যুৎ বিল ৪ হাজার ৫০০ টাকা হয়, তাহলে ৫০–৬০টি রিকশা চার্জ দেওয়ার মতো বিদ্যুৎ ব্যবহার হওয়ার কথা। কিন্তু এই গ্যারাজে কখনও কখনও ১০০টিরও বেশি রিকশা চার্জ দেওয়া হয়। অর্থাৎ বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের আড়ালে অবৈধ চার্জিংও চলছে।
রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা চার্জিং স্টেশন
মিরপুরের রূপনগর এলাকায় পরিস্থিতি সবচেয়ে প্রকট—সঙ্কীর্ণ গলিতে শত শত অননুমোদিত গ্যারাজ চলছে। রাস্তার স্ট্রিটলাইট ও বৈদ্যুতিক খুঁটিই হয়ে উঠেছে এসব চার্জিং পয়েন্টের উৎস। ল্যাম্পপোস্ট থেকে ঝুলে থাকে মোটা তারের গোছা, খোলা জায়গায় ঝুলে থাকে চার্জিং অ্যাডাপ্টার।
প্রতিটি রিকশা চার্জ দিতে মালিকদের খরচ হয় ১০০–১৫০ টাকা। রাত হলে প্রধান সড়কের ধারে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় রিকশা, আর চালকেরা অবৈধ লাইনে সংযোগ দিয়ে চার্জ নেন।
রূপনগরের চালক সাহাব আলী বেপারী বলেন, "আমি পাশের একটা গ্যারাজে প্রতিদিন ১২০ টাকা দিই। বড় গাড়িগুলো দেয় ১৫০। আগে এখানে ১৫–২০টা গ্যারাজ ছিল। এখন প্রত্যেকে গলিতেই একটা করে আছে।"
তিনি আরও জানান, এলাকার অনেক বাড়ির মালিকও গ্রাউন্ড ফ্লোরকে গ্যারাজে রূপান্তর করেছেন। "একটা ভবন আগে ভাড়া পাওয়া যেত ২৫ হাজার টাকায়। এখন গ্যারাজ হিসেবে ৪০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। গ্যাস–পানির বিলের ঝামেলাও নেই।"
জাতীয় চিড়িয়াখানার কাছাকাছি রাস্তার ধারে বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে সরাসরি চার্জ নিচ্ছে এরকম অসংখ্য রিকশা দেখা গেল।
চিড়িয়াখানার কাছে একটি গ্যারাজের মালিক রাসেল দাবি করেন, তার কার্যক্রম বৈধ।
"আমার মিটার আছে। কিন্তু আশপাশের বেশিরভাগ গ্যারাজই অবৈধ লাইন ব্যবহার করে। অবৈধ সংযোগ ছাড়া গ্যারাজ চালানো সম্ভব নয়। ডেসকোর লোকজন আসে, কিন্তু 'ম্যানেজ' হয়ে যায়," বলেন তিনি।
তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়া রোডে রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধ অটোরিকশা ঝুলন্ত তারে সংযুক্ত অবস্থায় চার্জ নিতে দেখা যায়।
একজন গ্যারাজকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "বেশিরভাগ গ্যারাজেই মিটার আছে, কিন্তু অল্প কয়েকটি গাড়ি সেই মিটার ব্যবহার করে। রাস্তারধারে প্রায় সব রিকশাই অবৈধ লাইন থেকে চার্জ নেয়। দেখানোর জন্য মিটার চলছে, কিন্তু আসল ব্যবসা চলে অবৈধ সংযোগে।"
কী বলছে কর্তৃপক্ষ
গৃহস্থালি বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ১৪ টাকার বেশি হলেও ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনের জন্য দাম প্রায় ১০ টাকা। ফলে অধিকাংশ গ্যারাজ বৈধ সংযোগ নিলেও পাশাপাশি অবৈধ লাইনও চালায়।
ডেসকোর রূপনগর সার্কেলের এসঅ্যান্ডডি অপারেশনের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শহাদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ওই এলাকা থেকে অবৈধ চার্জিং পয়েন্টের অভিযোগ আগেও পেয়েছি, এখন নিয়মিত সকাল, দুপুর ও রাতে অভিযান চালাচ্ছি। অবৈধ সংযোগ পেলেই জরিমানা করে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।"
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) নির্বাহী পরিচালক (ফাইন্যান্স) মোহাম্মদ হায়দার আলী টিবিএসকে বলেন, তারা অবৈধ সংযোগের বিষয়টি জানেন এবং নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন।
তিনি বলেন, "আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট ও কর্মকর্তারা অভিযানে গিয়ে নিয়ম ভঙ্গকারীদের শাস্তি দিচ্ছেন। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে এখন সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।"
ডেসকো ও ডিপিডিসির কর্মকর্তাদের মতে, ঢাকার বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় বর্তমানে সিস্টেম লস প্রায় ৫.৫ শতাংশ।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ আজাজ টিবিএসকে বলেন, "আমরা শিগগিরই ডেসকোর সঙ্গে বসব এবং তারা যেসব চার্জিং স্টেশনকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে, সেগুলো নিয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে বলব। পাশাপাশি আমাদের আওতাধীন সব অবৈধ চার্জিং স্টেশন বন্ধে সমন্বিত অভিযান শুরু করার প্রস্তুতি চলছে।"
এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা জানান, তারা চালকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তবে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা এখনো চালু হয়নি। ফলে সব ব্যাটারিচালিত রিকশাই বর্তমানে অননুমোদিতভাবে চলছে।
সরকারের নতুন নীতিমালা প্রস্তুত
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার 'ইলেকট্রিক থ্রি-হুইলার ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনস ২০২৫' তৈরি করেছে।
খসড়া নির্দেশিকার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে—বাধ্যতামূলক নিবন্ধন, ফিটনেস সার্টিফিকেট, ড্রাইভারের লাইসেন্স, মহাসড়কে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা, গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদনকারীদের জন্য অনুমতি, অবৈধ চার্জিং স্টেশন দমনে অভিযানসহ আরও নানা বিধান।
স্থানীয় সরকার বিভাগের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলেই গেজেট প্রকাশ করা হবে।"
