পয়লা বৈশাখ এলেই যেভাবে বাড়তি খাজনা, ভাড়ার উদ্বেগ তাড়া করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ভাড়াটিয়াদের

পয়লা বৈশাখ বাঙালির সংস্কৃতির এক আনন্দঘন দিন, তবে কালক্রমে এদিনটি আর সবার জন্য উৎসবের আমেজ নিয়ে হাজির হয় না। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি নিয়ে বরং অনেকেই থাকেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। মাথায় আসে খরচ বাড়ার চিন্তা। ফলে তাদের কাছে পয়লা বৈশাখ উৎসব না, খরচ বাড়ার আনুষ্ঠানিক দিন।
এই ভোগান্তি দিয়েই বছর শুরু হয় দোকানঘর ও বাসাবাড়ির ভাড়াটিয়াদের। কারণ এদিন বাংলাদেশের শহর এবং গ্রামগঞ্জের সব খানে হাটবাজার, নদীর ঘাটে নতুন ইজারাদার বসে। নতুন করে টোল ও খাজনা নেয়। বাসাবাড়ি ও দোকানঘরের মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। অনেকেই তাদের পুরনো দোকানঘর ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে ফেলে। পয়লা বৈশাখ থেকেই শুরু হয় এমন উলট-পালট।
এভাবে পয়লা বৈশাখ নিয়ে সোমবার লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ক্ষুদ্র দোকানি মো. আবুল হাসেম। আবুল হোসেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন, "প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ এলেই আমাদের জীবনে নেমে আসে নতুন নতুন দুশ্চিন্তা।" তিনি বিভিন্ন বাজারে ফুটপাতে ও দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করেছেন। প্রতি বছরই কখনো এদিন ফুটপাতে ব্যবসার জায়গা হারিয়েছেন, নাহলে দোকান হারিয়েছেন ভাড়া বৃদ্ধির কারণে।
একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন, পান ব্যবসায়ী শাহজাহান। তিনি জানান, "দীর্ঘ ১৫ বছর লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে পাইকারিতে পানের ব্যবসা করেন। কিন্তু এসব কারণে কয়েকটি বাজার থেকে দোকানের পজিশন হারিয়েছি। বর্তমানে ব্যবসা করি মান্দারি বাজারে। কিন্তু জানি এবছরেও নতুন হারে খাজনা দিতে হবে।"

লক্ষ্মীপুর শহরের একটি বিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক মো. হারুন অর রশিদ ব্যাখ্যা করে জানান, "পয়লা বৈশাখ এলেই বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের হাটবাজার ও ঘাটে ঘাটে নতুন ইজারাদার আসে। কারণ বছরের শুরুতে ইজারা নবায়ন হয় বা নতুন ইজারা দেওয়া হয়। ফলে পূর্বের তুলনায় হাটবাজার এবং ঘাটের টোল ও খাজনা বেড়ে যায়। মানুষের খরচ বাড়ে। আর তখন মালিকরা বাসাবাড়ি ও দোকান ঘরের ভাড়া বাড়িয়ে দেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে এটা অনেকটা ব্যক্তিগত ও প্রশাসনিক নিয়মিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
এই শিক্ষক বলেন, "আমার বাসা ভাড়াও পয়লা বৈশাখ থেকে বেড়েছে।"
স্থানীয় তোরাবগঞ্জ বাজারের সাবেক ইজারাদার মোঃ বেলাল হোসেন বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে বিভিন্ন হাট-বাজার ও ঘাট ইজারা দেয় সরকার। প্রতি বছরই বিগত বছরের তুলনায় বেশি মূল্যে ইজারা প্রদান করা হয়। নতুন ইজারাদার এসে বিগত বছরের তুলনায় বেশি দাম দিয়ে ইজারা নেয়।
"ফলে তারা দোকানদার ও ঘাট ব্যবহারকারীদের থেকে তাঁরা বেশি ভাড়া আদায় করেন, যেটা পয়লা বৈশাখ থেকে কার্যকর হয়। এ কারণে বৈশাখ এলেই দোকানদারদের খরচ বাড়ে। দোকানদাররা সে খরচ পোষাতে দাম বাড়িয়ে নেয় ক্রেতাদের থেকে" - তিনি যোগ করেন।

মুদি ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন হালখাতার নামে আরেক ভোগান্তির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, "পহেলা বৈশাখে আমাদের নোয়াখালীর চৌমুহনী আড়তে হালখাতা করতে হয়। এটাও আমাদের জন্য বাড়তি চাপ।" তিনি বলেন, তাই বৈশাখ মানেই আমাদের কাছে আতংক। কারণ হালখাতা, দোকান ভাড়া, বাজারে ইজারা বৃদ্ধি সব কিছুই কার্যকর হয় পয়লা বৈশাখে।"
কলেজ শিক্ষক মো. মহিউদ্দিন মুন্না বলেন, পহেলা বৈশাখ এলেই ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ পড়ে, বিশেষ করে যারা ছোট ব্যবসায়ী বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত। অনেক সময় মালিক তার পূর্বের ভাড়াটিয়াকে দোকানঘর ও বাসাবাড়ি থেকে একেবারে বের করেও দেন— যাতে নতুন ভাড়াটিয়াকে তা উচ্চ ভাড়ায় দেওয়া যায়।
তিনি বলেন, এতে পয়লা বৈশাখে অনেকে তার বহু দিনের পুরো ব্যবসা ও বাসাবাড়ি হারিয়ে ফেলেন। তাই দিনটি এখন যেন খরচ বৃদ্ধি ও কার্যকরের দিনে পরিণত হচ্ছে। এজন্য অন্যরা উদযাপনের অংশ নিলেও উদ্বেগ আর আতংকে থাকে এক শ্রেণির স্বল্প আয়ের মানুষ।