শ্রদ্ধাঞ্জলি—খালেদা জিয়া: এক আপসহীন আলোকবর্তিকার বিদায়
মঙ্গলবার সকালে এক বিষণ্ণ ও শোকাতুর খবরে দেশের মানুষের ঘুম ভাঙে—অবসান ঘটে বেগম খালেদা জিয়ার বর্ণাঢ্য জীবনের। তাঁর মৃত্যুতে দেশজুড়ে গভীর শোকের আবহ। দেশের রাজনীতির এক অত্যন্ত সংকটময় মুহূর্তে তিনি পাড়ি জমালেন পরপারে, যখন অতীতের মতো আবারও দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল।
খালেদা জিয়া জন্মগতভাবে রাজনীতিবিদ ছিলেন না। এমনকি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক জিয়াউর রহমান যখন দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তখনও তিনি জনসমক্ষে খুব একটা আসতেন না এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তাঁর আগ্রহও ছিল সামান্য। বিবিসি তাঁর মৃত্যুপরবর্তী স্মৃতিচারণায় লিখেছে, 'সে সময় বেগম জিয়াকে বর্ণনা করা হতো একজন "লাজুক গৃহবধূ" হিসেবে, যিনি তাঁর দুই সন্তানকে লালন-পালনেই নিবেদিত ছিলেন।'
কিন্তু ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড তাঁর জীবনের গতিপথ চিরতরে বদলে দেয়। এর ফলেই পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশের এক আপসহীন নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন।
রাজনীতিতে তাঁর অভিষেক যেন সময়েরই দাবি ছিল।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। তবে জিয়ার স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা ১৯৮১ সালের নভেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিএনপিকে জয়ী হতে সাহায্য করে। জিয়ার উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং বিএনপি ক্ষমতা ধরে রাখে।
কিন্তু চার মাস পার হওয়ার আগেই ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদ এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিএনপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তিনি দেশে সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন।
এর ফলে বিএনপি এক চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। অনেক নেতা স্বেচ্ছায় অথবা বাধ্য হয়ে এরশাদ সরকারে যোগ দেন। দলের অভ্যন্তরেও কোন্দল দানা বাঁধতে থাকে। সেই মুহূর্তে বিএনপির এমন একজনকে প্রয়োজন ছিল, যিনি দলটিকে একসূত্রে গেঁথে ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হবেন। এটিই ছিল নেতা হিসেবে খালেদা জিয়ার নবজন্মের মাহেন্দ্রক্ষণ। তিনি কেবল নিজের দলকেই পুনর্গঠিত করেননি, বরং সামরিক স্বৈরশাসককে উৎখাত করতে এক বিশাল গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি সাধারণ সদস্য হিসেবে বিএনপিতে যোগদানের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি দলের ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে দল তাকে চেয়ারপারসন হিসেবে নির্বাচিত করে।
এরশাদের নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী শাসন উৎখাত করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য খালেদা জিয়া এক সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে এরশাদের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বেগবান করতে সাত-দলীয় জোট গঠনের মূল কারিগর ছিলেন তিনি।
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে যখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী জাতীয় পার্টির অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, খালেদা জিয়া সেই নির্বাচন বর্জন করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া মানেই এরশাদের অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেওয়া। তাঁর এই অনমনীয় অবস্থানের কারণে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তাঁকে সাতবার আটক করা হয়।
খালেদা জিয়া বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে সংগঠিত করেন এবং তারা সারা দেশের ৩২১টি ছাত্র সংসদের মধ্যে ২৭০টিতেই জয়লাভ করে। এরশাদ সরকারের পতনে এই ছাত্ররাই ছিল আন্দোলনের মূল শক্তি। আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর অটল অবস্থান এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দৃঢ় অঙ্গীকারের কারণে তিনি 'আপসহীন নেত্রী' হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর আপসহীন ভাবমূর্তির ফলে তৈরি হওয়া ঢেউ ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জয় বয়ে আনে। এটি ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং একই সঙ্গে হাসিনানেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের জন্য বড় ধাক্কা, যারা একটি রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর পর পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার ব্যাপারে আশাবাদী ছিল।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় আসা ছিল এক অনন্য রেকর্ড, কারণ এটিই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম নির্বাচন। তাঁর সরকারই বাংলাদেশকে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য এক নতুন শুরু। তাঁর সরকার ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার, বাণিজ্যের উদারীকরণ, নারী শিক্ষা এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিপথ পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা করে।
তিনি বিএনপিকে তিনটি সাধারণ নির্বাচনে জয়ী করেন এবং তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর এক অনন্য রেকর্ড হলো—তিনি কখনো কোনো আসনে পরাজিত হননি। ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি পাঁচটি করে আলাদা সংসদীয় আসনে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি যে তিনটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তার সবকটিতেই জয়ী হন।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে ১১৬টি আসন জিতে দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর তিনিই প্রথম রাজনৈতিক জোট গঠন করে ২০০১ সালের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হন।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি যেমন এরশাদ সরকারকে হঠিয়েছিলেন, তেমনি ২০১১ সাল থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। কারণ, হাসিনা সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পরিকল্পিতভাবে ওই ব্যবস্থা বাতিল করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল।
বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে হাসিনা সরকার ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে কারারুদ্ধ করে এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে। তবুও তাঁর দল তাঁর পথ অনুসরণ করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে, নেতা-কর্মীদের ওপর নির্মম দমন-পীড়ন ও লক্ষ লক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা সত্ত্বেও। তাঁর শুরু করা সেই আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত গত বছরের আগস্টে (২০২৪) এক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পথ প্রশস্ত করে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর খালেদা জিয়া মুক্তি পান। কিন্তু ততদিনে তাঁর শারীরিক জটিলতা গুরুতর আকার ধারণ করে। গত কয়েক মাস তাঁকে হাসপাতালের বিছানা আর ঘরের মধ্যে আসা-যাওয়ার মধ্যেই কাটাতে হয়েছে।
১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর তিনি যেভাবে দলকে জয়ের পথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এবার আর তা হলো না। আসন্ন ফেব্রুয়ারি (২০২৬) নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং রুগ্ন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সেখানে খালেদা জিয়ার অভাব গভীরভাবে অনুভূত হবে।
গণতন্ত্র রক্ষার যে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বেগম খালেদা জিয়া রেখে গেছেন, তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন তাঁর দল, ছেলে এবং লক্ষ লক্ষ শুভাকাঙ্ক্ষী ও অনুসারীদের কাঁধে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন
