সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে চাই: তারেক রহমান
রাজধানীর পূর্বাচলে আয়োজিত এক বিশাল গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, পাহাড় কিংবা সমতল—ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এমন এক নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিরাপদে ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবেন।
তিনি বলেন, 'আই হ্যাভ এ প্ল্যান। এই পরিকল্পনা দেশের মানুষের স্বার্থে, উন্নয়নের জন্য এবং মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য।'
এর আগে বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) লাল-সবুজ রঙে সাজানো একটি বাসে করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি পূর্বাচলে গণসংবর্ধনাস্থলে পৌঁছান তারেক রহমানকে বহনকারী গাড়িবহর। বেলা ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে তিনি মঞ্চে ওঠেন। মঞ্চে উঠে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে হাত নাড়েন তিনি। বেলা ৩টা ৫৭ মিনিটে 'প্রিয় বাংলাদেশ' সম্বোধনের মাধ্যমে তার বক্তব্য শুরু করেন। এ সময় মঞ্চে বিএনপির জাতীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
তারেক রহমান তার বক্তব্যে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের আন্দোলনের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে বলেন, '৭১-এ দেশের মানুষ যেমন স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, ২০২৪ সালেও ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক, গৃহবধূসহ সর্বস্তরের মানুষ একইভাবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছে। বাংলাদেশের মানুষ আজ কথা বলার ও গণতন্ত্রের অধিকার ফিরে পেতে চায়। তারা যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য অধিকার চায়।'
তিনি আরও স্মরণ করেন ৭৫-এর ৭ই নভেম্বর আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে দেশ রক্ষা এবং ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কথা।
তারেক রহমান বলেন, 'আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই যা একজন মা স্বপ্ন দেখেন—একটি নিরাপদ বাংলাদেশ। সেখানে নারী, পুরুষ বা শিশু যেই হোক না কেন, নিরাপদে ঘর থেকে বের হলে যেন নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারে।'
তিনি দেশের জনসংখ্যার বৈচিত্র্য তুলে ধরে বলেন, 'দেশে ৪ কোটির বেশি তরুণ, ৫ কোটির মতো শিশু, ৪০ লক্ষ প্রতিবন্ধী এবং কোটি কোটি কৃষক-শ্রমিক রয়েছেন। এই লক্ষ কোটি মানুষের প্রত্যাশা পূরণে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।'
বিগত ১৫ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুম-খুনের শিকার রাজনৈতিক কর্মী ও নিরীহ মানুষের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২৪-এর আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মের সাহসী সদস্য ওসমান হাদি শহীদ হয়েছেন। তার মতো শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করতে আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়তে হবে। একইসঙ্গে তিনি সতর্ক করে বলেন, 'আধিপত্যবাদী শক্তির গুপ্তচরেরা এখনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে দায়িত্ব নিতে হবে যাতে শক্ত গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দেশকে গড়ে তোলা যায়।'
তারেক রহমান মার্কিন নাগরিক অধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর 'আই হ্যাভ এ ড্রিম' বক্তব্যের উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'আজ বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমি বলতে চাই, "আই হ্যাভ এ প্ল্যান, ফর দ্য পিপল অফ মাই কান্ট্রি, ফর মাই কান্ট্রি।" এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের সহযোগিতা লাগবে।'
তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, আগামী দিনে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যারা আসবে, তারা নবী করিম (সা.)-এর ন্যায়পরায়ণতার আলোকে দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তারেক রহমান তার মা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কথা উল্লেখ করে আবেগাপ্লুত হন। তিনি বলেন, 'সন্তান হিসেবে আমার মন মায়ের হাসপাতালের বিছানার পাশে পড়ে আছে। কিন্তু তিনি যাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই মানুষগুলোকে ফেলে আমি যেতে পারি না। সেজন্য হাসপাতালে যাওয়ার আগে আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি।' তিনি বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান।
সবশেষে তিনি যেকোনো উস্কানির মুখে ধৈর্য ও শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'যেকোনো মূল্যে আমাদের দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। কোনো বিশৃঙ্খলা করা যাবে না। ধর্ম, দল বা শ্রেণী নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ যেন নিরাপদ থাকে, এটাই হোক আমাদের চাওয়া।'
'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' ও 'বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জিন্দাবাদ' স্লোগান দিয়ে তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন।
এর আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বহনকারী উড়োজাহাজটি আজ (২৫ ডিসেম্বর) বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর দেশে ফিরলেন তিনি।
বিমানবন্দরে পরিবারসহ তারেক রহমানকে স্বাগত জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। এ সময় ফুলের মালা দিয়ে জুবাইদা রহমানের মা তারেক রহমানকে বরণ করে নেন।
তারেক রহমান তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে সকাল ৯টা ৩৪ মিনিটে দেওয়া এক পোস্টে লেখেন: 'দীর্ঘ ৬ হাজার ৩শ ১৪ দিন পর বাংলাদেশের আকাশে!'
গতকাল স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত সোয়া ১২টা) ঢাকার উদ্দেশে বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইটে (বিজি ২০২) করে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর ত্যাগ করেন তিনি। তার সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও কন্যা জাইমা রহমান।
প্রায় ১৮ বছর লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর তারেক রহমানের এ প্রত্যাবর্তন রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। বিএনপির দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে আজ।
তারেক রহমানের প্রয়াত ভাই আরাফাত রহমান কোকোর দুই কন্যা জাহিয়া রহমান ও জাফিয়া রহমানও একই ফ্লাইটে রয়েছেন। এছাড়া সাংবাদিক সালেহ শিবলী এবং তারেক রহমানের কয়েকজন ব্যক্তিগত সহকারীও ফ্লাইটটিতে আছেন।
তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানের পোষা বিড়াল জেবুও পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে আসছে।
ফ্লাইটটি আজ বৃহস্পতিবার বেলা আনুমানিক ১১টা ৪৫ মিনিট থেকে ১১টা ৫০ মিনিটের মধ্যে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের কথা রয়েছে।
দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যসহ বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা শাহজালাল বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত রয়েছেন।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশের পাশাপাশি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার প্রস্তুতিও গ্রহণ করা হয়েছে। তার আগামী কয়েকদিনের ব্যস্ত সূচিতে ব্যক্তিগত কর্মসূচি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তারেক রহমানের প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার হলো সরাসরি এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অসুস্থ মা, খালেদা জিয়াকে দেখতে যাওয়া। তবে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যাত্রাপথের মাঝামাঝি রাজধানীর 'জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়ে' (৩০০ ফিট) এলাকায় তিনি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেশবাসীর উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন। সেখান থেকে হাসপাতাল এবং তারপর সরাসরি গুলশানে নিজ বাসায় যাবেন।
দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এটি কোনো জনসভা বা সংবর্ধনা অনুষ্ঠান নয়, শুধুমাত্র দেশবাসীর প্রতি তার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং খালেদা জিয়াসহ দেশের সকল মানুষের কল্যাণ কামনায় দোয়ার অনুরোধের একটি সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি। এই আয়োজনে তারেক রহমানই একমাত্র বক্তা।
