গুরুত্বপূর্ণ কাজ অসমাপ্ত; নির্বাচনি প্রস্তুতিতে অগোছালো ইসি
চলতি মাসের শুরুর দিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং একইসঙ্গে গণভোটের তফসিল ঘোষণা করা হলেও, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি এখনো শেষ করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এসব অসমাপ্ত কাজ কমিশনের সামগ্রিক প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ হয়নি, মুদ্রিত হয়নি নির্বাচনি ম্যানুয়ালও। এছাড়া তফসিল ঘোষণার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও কমিশন প্রয়োজনীয় বেশ কিছু পরিপত্র জারি করতে হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যেই নির্বাচনি সময়সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, নির্বাচনি আচরণবিধিতে আরও পরিবর্তন আসতে পারে।
গত ১১ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তবে ১৮ ডিসেম্বর তফসিল-সংক্রান্ত ওই প্রজ্ঞাপনে কিছুটা সংশোধন আনে কমিশন। এক্ষেত্রে মনোনয়পত্র বাছাইয়ে রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তির তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। আপিল করার সময় দুই দিন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর দুই দিন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আপিল নিষ্পত্তির সময়।
প্রথমে ঘোষিত ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়পত্র বাছাইয়ে রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের তারিখ ছিল ৫ থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সেই সময় কমিয়ে করা হয়েছে ৫ থেকে ৯ জানুয়ারি। আর আপিল নিষ্পত্তির তারিখ ছিল ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। সেই সময় দুই দিন এগিয়ে এনে করা হয়েছে ১০ থেকে ১৮ জানুয়ারি।
গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ জানান, পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনে আচরণবিধিতে আরও সংযোজন বা বিয়োজন করা হতে পারে।
প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, সামগ্রিকভাবে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কার কারণ দেখছেন না একজন নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক একজন নির্বাচন কর্মকর্তা।
তাদের মতে, আচরণবিধি বা আইনি কিছু সংশোধন নির্বাচনকালীন সময়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ এবং প্রয়োজনে যেকোনো সময়ই তা করা যায়।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন তুলি টিবিএসকে বলেন, বাইরে থেকে কমিশনের অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতির পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করা কঠিন।
'তবে আচরণবিধি বা আরপিওর ছোটখাটো সংশোধন যেকোনো সময়ই করা যায়। সেটাই তারা করছে বলে মনে হয়,' বলেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ টিবিএসকে জানান, নির্বাচনি ম্যানুয়াল প্রায় চূড়ান্ত এবং সই হওয়ার পরই এটি মুদ্রিত হয়ে মাঠপর্যায়ে পৌঁছাবে।
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, 'সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত কিছু মামলা পেন্ডিং থাকলেও এটি নির্বাচনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। নির্বাচনে নানা চ্যালেঞ্জ থাকবে। মনোনয়ন বা সীমানা নিয়ে আপত্তি থাকা স্বাভাবিক।'
বর্তমান কমিশন ৩৯টি সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন এনেছে। তবে বাগেরহাটের আসন সংখ্যা চার থেকে কমিয়ে তিন করার কমিশনের একটি সিদ্ধান্ত আদালত বাতিল করে দিয়েছে।
গাজীপুরের পাঁচটি আসন আগের মতো থাকবে। ফরিদপুর-৪ আসনের ভাঙ্গা উপজেলা থেকে আলগি ও হামিরদি ইউনিয়ন ফরিদপুর-২-এর সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্তও বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে কুমিল্লা, পঞ্চগড়, রংপুর ও বরগুনার সীমানা নিয়ে চারটি মামলা উচ্চ আদালতের শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
দল নিবন্ধনে বিলম্ব
নির্বাচন কমিশনের অন্যতম বড় একটি অমীমাংসিত কাজ হলো নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন।
কমিশন সাতটি দলের আবেদন পর্যালোচনা করেছে। এতে মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, গণতান্ত্রিক পার্টি, জাসদ-শাহজাহান সিরাজ, জাতীয় জনতা পার্টি, জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও জনতা দল।
কিন্তু এখনও কোনো দলকে চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন দেওয়া হয়নি।
চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে, এমন একটি দলের প্রধানকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আগারগাঁওয়ের নির্বচান কমিশনের নিচতলায় অপেক্ষায় দেখা যায়। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে, কিন্তু চূড়ান্ত নিবন্ধন নেই। আমরা এখন ইসির বারান্দায় ঘুরছি, অথচ প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার কাজে সময় দেয়া কথা ছিল এখন।'
নিরাপত্তা উদ্বেগ
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরীফ ওসমান বিন হাদির ওপর গুলি এবং পরবর্তীতে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যুতে প্রার্থীদের নিরাপত্তা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই হামলার শিকার হন হাদি।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জুলাইয়ের সম্মুখ সারির যোদ্ধা ও নির্বাচনে প্রার্থীদের বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তার ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিকভাবে 'গুরুত্বপূর্ণ' ব্যক্তি ও প্রার্থীদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার এবং রিটেইনার (গানম্যান) নিয়োগের সুযোগ দিতে ১৫ ডিসেম্বর নীতিমালা জারি করে সরকার।
এর আগে ১৪ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে ইসি। কমিশন জানায়, ভোটের আগে নিরাপত্তা জোরদারে বাড়তি চেকপোস্ট বসানো, সশস্ত্র অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সাঁড়াশি অভিযান চালানো প্রয়োজন।
তবে ১৭ ডিসেম্বর ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানান, প্রার্থীদের আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইসির আগে থেকে কোনো আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন, 'স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিরাপত্তার বিষয়টা বিবেচনা করে যেটা ভালো মনে করেছেন, সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর নিশ্চয়ই সবাই একমত যে নিরাপত্তার বিষয়টা প্রাধান্য পাক।'
গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মেইল প্রসেসিং অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিস সেন্টারে বিদেশের পোস্টাল ব্যালট পাঠানোর প্রক্রিয়া পরিদর্শন শেষে সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে তিনি আশাবাদী।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। অসুবিধা হবে না। দেখবেন, আমরা তো কনফিডেন্ট আছি। আমরা তো হাল ছাড়িনি। আমরা এগিয়ে যাব।'
