বিএনপি ক্ষমতায় এলে ‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্রায়ন’ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করা হবে: আমীর খসরু
জনগণের ভোটের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে 'অর্থনৈতিক গণতন্ত্রায়ন' বাস্তবায়ন করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, বিএনপি দেশে কোনো পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি দেখতে চায় না। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পাশাপাশি মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াই হবে তাদের লক্ষ্য।
সোমবার (২২ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর হোটেল রেডিসন ব্লুতে আয়োজিত এক বাণিজ্য সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যবসায়ী ফোরামের উদ্যোগে ব্যবসা, বাণিজ্য, অর্থনীতি ও বিনিয়োগ বিষয়ক এই সংলাপের আয়োজন করা হয়।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, 'দেশের অর্থনীতি উন্নয়নের সঙ্গে যদি মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকে এবং এর সুফল মানুষ না পায়, তবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার আমাদেরকে ফিরিয়ে দিতে হবে। আমরা কোনো পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি বাংলাদেশে দেখতে চাই না।'
ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, 'এখানে ব্যবসায়ীরা বলেছেন তারা ব্যবসা করতে চান, ব্যবসার পরিবেশ ও নীতিমালা চান। ডেমোক্রেটাইজেশন অব ইকোনমি বা অর্থনীতির গণতন্ত্রায়নের অর্থ হলো সকলের অধিকার সমুন্নত রাখা ও সুরক্ষা করা।'
বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'আমি দুঃখের সাথে বলছি, বাংলাদেশ 'হাইলি রেগুলেটেড' (অতি নিয়ন্ত্রিত) কান্ট্রি। একটি রেস্টুরেন্ট করার জন্য ১৯টি বা ২১টি অনুমোদন লাগে। শিপব্রেকিংয়ের পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য দুই মাস লাগে। প্রত্যেকটি ব্যবসাতে এই যে ওভার রেগুলেটেড করে রাখা হয়েছে, এখান থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। সুতরাং আমাদের পলিসি হচ্ছে গো ফর সিরিয়াস ডি-রেগুলেশন। ইজ অব ডুইং বিজনেসের সূচকে বাংলাদেশের স্থান একদম নিচে।'
অতীতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাবেক এই বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, 'আমি যখন বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলাম, তখন বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দ একদিন বললেন তাদের ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) সার্টিফিকেট লাগে। আগে এটি ইপিবি (রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো) থেকে দেওয়া হতো, যেখানে টাকা-পয়সা ও হয়রানির ব্যাপার ছিল এবং শিপমেন্টে বিলম্ব হতো। ব্যবসায়ীরা আমাকে ইপিবিকে ঠিক করে দিতে বললেন। কিন্তু ইপিবি যেহেতু শক্তিশালী, তাই আমি ইউডি সার্টিফিকেট ইস্যুর ক্ষমতা ইপিবির হাত থেকে নিয়ে বিজিএমইএ-র হাতে দিয়ে দিলাম। এখন তারাই এটি দিচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'এজন্য আমার বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন হয়েছিল, কারণ এটি ছিল তাদের ক্যাশ ইনকাম। আগামী দিনে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে আমলাতন্ত্রের হাতে যা যা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আমরা তা বের করে আনব। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলব আপনারা প্রপারলি, প্রফেশনালি, ইন্ডিপেন্ডেন্টলি এবং ট্রান্সপারেন্টলি নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করুন, যেন সরকার অনেকগুলো দায়িত্ব আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারে।'
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, 'সাধারণত ব্যবসায়ীদের মন্ত্রী বা এমপির কাছে যেতে হয়। আমরা এই কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে চাই, যাতে আপনারা আমাদের কাছে না এসে আমরা আপনাদের কাছে যেতে পারি। আমরা রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতার কথা বলি, কিন্তু প্রক্রিয়াটি বলি না। রাজনীতিবিদদের প্রশ্ন করে জবাবদিহিতার আওতায় আনার প্রক্রিয়া আমরা চালু করেছি।'
ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, 'আগামী দিনে আপনাদের ভোটে ক্ষমতায় এলে আপনাদের কথা শুনতে ফিরে আসব। আগের মতো চলবে না। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা ও মনোজগতে পরিবর্তন হয়েছে। তাই জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমেই দেশ চলতে হবে।'
কর্মসংস্থান বাড়াতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) ওপর গুরুত্বারোপ করেন বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, 'অর্থনীতিতে প্রধান অবদান রাখে এসএমই। কর্মসংস্থানের আকার না বাড়ালে জিডিপিও বাড়বে না। বিএনপির অঙ্গীকার করা ৫০০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এসএমই প্রবৃদ্ধি ছাড়া সম্ভব নয়। এজন্য আরএমজি সেক্টরের মতো বন্ডেড ওয়ারহাউস, ব্যাক টু ব্যাক এলসি ইত্যাদি সুবিধা রপ্তানিমুখী প্রতিটি খাতে নিশ্চিত করা হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকারি অফিসে ঘুরাঘুরির দরকার নেই। অটোমেশনের মাধ্যমে ফিজিক্যাল কন্টাক্ট বা সরাসরি যোগাযোগ কমিয়ে আনতে হবে। সরকারি কর্মকর্তার সাথে ব্যবসায়ী ও সাধারণ নাগরিকদের যোগাযোগ মিনিমাম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।'
বন্দরে হয়রানি কমানোর পরিকল্পনা তুলে ধরে আমীর খসরু বলেন, 'পোর্টে কনটেইনার রিলিজের সময় কমাতে আগামী দিনে ইন্টেলিজেন্সি ব্যবহার করা হবে। মাত্র ২ শতাংশ কার্গো চেক করা হবে, তাও অ্যালগরিদম ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে। ফলে কাস্টমস অফিসারদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের সুযোগ থাকবে না। এতে দুর্নীতি এবং চাঁদাবাজি আর থাকবে না।'
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আলী আহম্মদের সভাপতিত্বে সংলাপে বিভাগের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ফোরাম ও বাণিজ্যিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন এবং খাতভিত্তিক প্রতিবন্ধকতা ও সমাধানের কথা তুলে ধরেন।
সংলাপে বক্তব্য রাখেন খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মীর আব্দুস সালাম, সি-কম গ্রুপের মোহাম্মদ আমিরুল হক, বিজিএপিএমইএ-এর ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শহীদ উল্লাহ চৌধুরী, প্যাসিফিক জিন্সের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর, বিজিএমইএ-র প্রথম সহসভাপতি সেলিম রহমান, পিএইচপি গ্রুপের পরিচালক জহিরুল ইসলাম, বিজিএমইএ-র সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এমএ সালাম, চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলীসহ প্রমুখ ব্যক্তিরা।
