ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটার ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলা হচ্ছে
রাজশাহী নগরীর মিয়াপাড়ায় অবস্থিত বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈতৃক বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ও ইট সরিয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে।
মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) মহান বিজয় দিবসের সরকারি ছুটির দুপুরে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ট্রাকে করে এসব ইট সরাতে শুরু করলে স্থানীয় চলচ্চিত্রকর্মীরা তাতে বাধা দেন। এ ঘটনায় স্থানীয় সংস্কৃতি অঙ্গনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের (২০২৪) ৬ আগস্ট ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। এরপর প্রায় এক বছর ধরে বাড়ির আঙিনাতেই পড়ে ছিল সেই ধ্বংসাবশেষ। মঙ্গলবার ছুটির দিনে কলেজ কর্তৃপক্ষ সেই ইটের স্তূপ সরানোর উদ্যোগ নেয়।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে কাজ বন্ধ করে দেন রাজশাহীর চলচ্চিত্রকর্মীরা। তারা ঋত্বিকের জন্মভূমির শেষ নিদর্শনটুকু টিকিয়ে রাখতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
চলচ্চিত্রকর্মীদের অভিযোগ, ঋত্বিক ঘটকের বাড়ির শেষ চিহ্নটুকুও মুছে ফেলার চক্রান্ত চলছে। ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনা না করে এই ভিটার ইট ও ধ্বংসস্তূপ দিয়ে অন্যত্র পুকুর ভরাট করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী চলচ্চিত্র সংসদের কর্মী অমিত রুদ্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'ঋত্বিক কুমার ঘটকের স্মরণে রাজশাহীতে উৎসব হয় এবং সেখানে বেস্ট স্ক্রিপ্ট অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। যারা ঋত্বিকের চিহ্ন মুছে দিতে চান, তাদের এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া যায় কি না, তা ভাবার সময় এসেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিষয়টি এমনই যে, প্রশাসনের সঙ্গে যখনই যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না, সেই ছুটির দিনগুলোতেই একটি চক্র ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি সরিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠে।'
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন রাজশাহী মহানগরের সাধারণ সম্পাদক নাদিম সিনা বলেন, 'গত বছরের ৫ আগস্ট রাতের আঁধারে ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। এরপরও আমরা তার দুটি জন্মবার্ষিকী উদযাপন করেছি এবং ধারাবাহিকভাবে দাবি জানিয়ে আসছি যে স্মৃতিচিহ্নটি সংরক্ষণ করা হোক।'
ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি আহসান কবির লিটন আক্ষেপ করে বলেন, 'প্রশাসন বারবার সংরক্ষণের কথা বললেও বাস্তবতা হলো, এই ঐতিহাসিক ইটগুলো পুকুর বা ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। একজন চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবে চোখের সামনে এমন গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন নষ্ট হতে দেখা ভাষায় প্রকাশ করার মতো কষ্টের নয়।'
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন মাসুদ জানান, ২০১৯ সালে এই বাড়িতে সাইকেল গ্যারেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তখন তদন্তে প্রমাণিত হয়, রামপুর মৌজার ১৭৮ নম্বর দাগের ৩৪ শতক এই জমির মূল মালিক ঋত্বিক ঘটকের মা ইন্দুবালা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তারা ভারতে চলে গেলে জমিটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় এবং ১৯৮৯ সালে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে ইজারা দেওয়া হয়।
মাসুদ আরও জানান, আন্দোলনের মুখে ২০২১ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তর ৫১ লাখ টাকা ব্যয়ে বাড়িটি সংরক্ষণের প্রাক্কলন তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। কিন্তু অজানা কারণে এরপর আর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) টুকটুক তালুকদার বলেন, 'কলেজের সামনের অংশ পরিষ্কার করার জন্যই মূলত ইটগুলো অপসারণ করা হচ্ছিল। তবে চলচ্চিত্রকর্মীরা বাধা দেওয়ার পর আমরা কাজ বন্ধ রেখেছি। তাদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
উল্লেখ্য, ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণকারী ঋত্বিক কুমার ঘটকের শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে রাজশাহীর এই বাড়িতে। তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করেছেন। এই বাড়িতে বসেই তিনি কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চা করতেন। এছাড়া ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি ও প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীও এই বাড়িতে বসবাস করেছেন।
