সুস্থ শৈশবের কয়েক বছর পরেও প্রকাশ পাচ্ছে অটিজমের লক্ষণ: গবেষণা
জন্মের সময় সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকা অনেক শিশুর মধ্যে তিন থেকে চার বছর পর অটিজমের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। এমনকি ১০ বছর বয়সেও এ ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট অটিস্টিক শিশুর প্রায় ৫০ শতাংশই জন্মের পর প্রথম কয়েক বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।
তবে আশার কথা হলো, 'ড্রিমস মেথড ফর অটিজম' নামে একটি সমন্বিত ইন্টারভেনশন মডেলের মাধ্যমে এসব শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ১২ বছরব্যাপী এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) ওয়ার্ল্ড ডিজঅ্যাবিলিটি ডে ২০২৫ উপলক্ষে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) শহীদ ডা. মিলন হলে আয়োজিত 'চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ফর নরমাল অ্যান্ড স্পেশাল চিলড্রেন' শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে গবেষণার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমইউর ফিজিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শরীফা শাহজাদি।
তিনি বলেন, "সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়ার পরও চারপাশের প্রতিকূল পরিবেশ কিংবা বাবা-মায়ের অসচেতনতায় শিশুরা ধীরে ধীরে প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে সঠিক ইন্টারভেনশনের মাধ্যমে তারা আবারও সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে। দীর্ঘ ১২ বছরের গবেষণাটি ৪০টিরও বেশি শিশুর ওপর পরিচালিত হয়েছে, যেখানে নিয়মিত নির্দিষ্ট ইন্টারভেনশন বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জ ছিল।"
তিনি জানান, দুই, পাঁচ, সাত এমনকি ১০ বছর বয়সী শিশুকেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। গতানুগতিক ওষুধের বিকল্প হিসেবে শুধু শারীরিক ব্যায়াম, পরিকল্পিত খাদ্যাভ্যাস ও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ সাফল্য এসেছে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই 'ড্রিমস মেথড' তৈরি করা হয়। গবেষণা কার্যক্রমে সহযোগিতা করেছে ঝিনাইদহের জাহান ইন্টারন্যাশনাল মডেল ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার।
সুস্থ শিশুদের মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ডা. শরীফা শাহজাদি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পরিবেশ ও পরিবারভিত্তিক পুষ্টিহীনতা একটি বড় কারণ। অনেক পরিবারে একই ধরনের খাবার, অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড ও জাঙ্ক ফুড খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এ ছাড়া শিশুর মোবাইল ও টেলিভিশন আসক্তি এবং বিভিন্ন মানসিক কারণও এর সঙ্গে জড়িত।
তিনি বলেন, বাবা-মা, শিক্ষক ও চিকিৎসকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ায় এখন কম বয়সেই অটিজমের লক্ষণ শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। উন্নত পরীক্ষা ও পদ্ধতির মাধ্যমে নির্ণয় সহজ হয়েছে। শিশু বয়স অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাইলফলক অর্জনে ব্যর্থ হলে বা অস্বাভাবিক আচরণ করলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ডা. শাহজাদি বলেন, "শুধু ওষুধ বা থেরাপি যথেষ্ট নয়। শিশুর খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, পরিবেশ ও দৈনন্দিন রুটিন মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টার একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ভিটামিন বা সাপ্লিমেন্ট অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণের ফলে টক্সিসিটি তৈরি হয়, যা সঠিক পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।"
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, একাধিক কেস স্টাডিতে দেখা গেছে—যেসব শিশুর মধ্যে আই কন্টাক্ট, নির্দেশনা অনুসরণ, যোগাযোগ ও স্পিচ একেবারেই ছিল না, ছয় মাসের মধ্যে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। এক শিশুর ক্ষেত্রে ছয় মাস পর স্পিচ, আই কন্টাক্ট ও যোগাযোগ ফিরে আসে এবং এক বছরের মধ্যে সে গল্প বলা ও অভিনয় করতে সক্ষম হয়।
আরেক শিশুর ক্ষেত্রে তিন বছর বয়সে অটিজম শনাক্ত হওয়ার পর ছয় মাসের সমন্বিত ইন্টারভেনশনে সামাজিক যোগাযোগ ও খেলাধুলা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসে। ১০ বছরের ফলোআপে কয়েকজন শিশু এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে, যা অভিভাবকেরা আগে কল্পনাও করতে পারেননি।
জাতীয় গাইডলাইনের দাবি
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল সমস্যার জন্য এখনো সুনির্দিষ্ট জাতীয় গাইডলাইন ও কার্যকর রেফারেল সিস্টেম নেই। বিএমইউকে কেন্দ্র করে একটি গবেষণাভিত্তিক 'সেন্টার অব এক্সিলেন্স' গড়ে তোলার আহ্বান জানান তারা, যাতে ঢাকার পাশাপাশি জেলা পর্যায়েও শিশুদের সমন্বিত চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।
চিকিৎসকদের মতে, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার ৩৭টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের চিকিৎসাসেবায় প্রবেশাধিকার আরও সীমিত হয়ে পড়বে।
অনুষ্ঠানে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, "শিশুদের মধ্যে অটিজম এখন মহামারির মতো আকার ধারণ করেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অনেক পরিবারের নিকট আত্মীয়দের মধ্যেও অটিস্টিক শিশু রয়েছে।"
তিনি বলেন, "আগে এমন শিশুর সংখ্যা কম ছিল না। তবে সামাজিক লজ্জা ও অস্বীকৃতির কারণে তারা আড়ালে থাকত। এখন পরিবারগুলো সামনে আসছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে এই সমস্যাগুলো অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।"
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অটিজম বৃদ্ধির পেছনে পরিবেশগত পরিবর্তন, জীবনযাত্রার ধরন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রভাব রয়েছে। এসব বিষয়ে আরও গবেষণা এবং একটি সমন্বিত জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দেন তারা।
