ক্ষমতা-অর্থ-পেশিশক্তি এই তিন মিলেই আমাদের রাজনৈতিক ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে: ইফতেখারুজ্জামান
ক্ষমতা, অর্থ ও পেশিশক্তি এই তিনটি মিলেই আমাদের রাজনৈতিক ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, 'আজকের আলোচনায় আমি মূলত পলিটিক্যাল ফিন্যান্স ও পলিটিক্যাল ফিন্যান্স কালচার নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু এর পেছনে আরও বড় বাস্তবতা আছে- পলিটিকাল ক্যাপিটাল। অর্থাৎ ক্ষমতা, অর্থ ও পেশিশক্তি এই তিনটি মিলেই আমাদের রাজনৈতিক ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। এই তিনটিকে একসঙ্গে বিবেচনা না করলে সমস্যার সমাধান হবে না।'
আজ সোমবার (২৪ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে (বিআইআইএসএস) ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্স (দায়রা) আয়োজিত 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থায়ন সংস্কৃতি এবং ব্যবসা সুরক্ষা: বাস্তবতা এবং সমাধানের পথ'- শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।
এসময় ড. ইফতেখার বলেন, 'বাংলাদেশের রাজনীতি এখন একটি ত্রিমুখী কাঠামোর মধ্যে বন্দী। রাজনীতি, প্রশাসন ও ব্যবসার শক্তি একে অপরের সঙ্গে জটিলভাবে জড়িয়ে গেছে। রিজার্ভেশন, রেন্ট-সিকিং, দুর্নীতি- এসব গভীরভাবে ভেতরে প্রবেশ করেছে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের রাজনৈতিক দলের অর্থায়নের মধ্যে যেমন বহু ধরনের অস্পষ্ট ইমপ্লিকেশন আছে, নির্বাচনি অর্থায়নও ঠিক একইভাবে বহু জটিলতার ভেতর দিয়ে যায়। নির্বাচন কমিশন (ইসি) আরপিও অনুযায়ী প্রচারণার জন্য ব্যয়ের যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে সীমা বাস্তবে মানা হয় না; এটা আমরা প্রায়ই দেখি। আর নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যয়ও অনেক বেড়েছে।'
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'এই পুরো ক্ষেত্রটিতে যদি স্বচ্ছতা না থাকে, তাহলে কোনো সংস্কারই কার্যকর হবে না। শুধু নির্বাচনের সময় কমিশনে বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন জমা দেওয়া যথেষ্ট নয়। রিপোর্ট কতটা গভীর, কতটা নির্ভরযোগ্য, সেটাই আসল প্রশ্ন। এসব ডকুমেন্টেশন কেমন হয়, কীভাবে হয় এসব বিষয়ে বহু প্রশ্ন থেকেই যায়।'
তিনি বলেন, 'আমি স্পষ্ট করে বলব, সমাধান নেই এমন নয়। বরং যেসব প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলাতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'নির্বাচন সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকেও বেশ কিছু সুপারিশ ছিল। তার একটি ছিল জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সব জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ্যে জমা দেবেন এবং তা পরবর্তীতে প্রতি বছর হালনাগাদ করবেন। কল্পনা করুন, এই শর্ত সঠিকভাবে কার্যকর হলে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহারের প্রবণতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হবে।'
ড. ইফতেখার বলেন, 'আমরা এতদিন যেসব হলফনামা দেখেছি, বিশেষ করে ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত; সেখানে বহু জনপ্রতিনিধির সম্পদ ২০০, ৫০০ এমনকি ১০০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত সরকারের সময় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কথা নির্বাচনি হলফনামায় উল্লেখ না করার বিষয়টি টিআইবি তুলে ধরলেও, কোনো ব্যবস্থা নেয়নি গত সরকার।'
তিনি বলেন, 'দেশের বাইরে সম্পদ, নানা অফিশিয়াল ডকুমেন্ট সবই ছিল। কিন্তু সেগুলোর ভিত্তিতে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ আমরা দেখিনি গত সরকারের সময়।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এটা নিয়ে কাজ করছে, তবে খুব বেশি আগ্রগতি হয়নি।'
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'আমরা মন থেকে পরিবর্তন চাই, এটা ঠিক। কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা সেই সুযোগ ব্যবহার করতে পারিনি। নতুন বাংলাদেশ, রাষ্ট্রসংস্কার, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এগুলো স্লোগান হিসেবে এসেছে। কিন্তু ৫ তারিখ সন্ধ্যা থেকে সারাদেশে চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্য, মামলা-বাণিজ্য, জামিন-বাণিজ্য-এগুলোই বাস্তব চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার পর প্রথম সংসদে জনপ্রতিনিধিদের মাত্র ১৭% এর মূল পেশা ছিল ব্যবসা। সর্বশেষ সংসদে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ শতাংশে। ব্যবসায়ী রাজনীতিতে আসবে এটা সমস্যা নয়। কিন্তু সমস্যা তখনই হয়, যখন রাজনীতি ব্যবসার পুঁজি হয়ে যায় এবং ব্যবসা রাজনৈতিক পুঁজি হয়ে যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকেও আমরা সৎভাবে প্রত্যাশা করেছিলাম রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায় কিছু মৌলিক সংস্কার হবে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব প্রকাশও হয়েছিল। কিন্তু কার্যকরভাবে কিছুই হয়নি। কারণ প্রতিরোধ রয়েছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবস্থার সুবিধাভোগী, তারা তো পরিবর্তন চায় না।'
ড. ইফতেখার বলেন, 'রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, সাধারণ মানুষ সবাই পরিবর্তন চাইছে। কিন্তু প্রত্যেকে চায় অন্যরা বদলে যাক, নিজেরা নয়।'
তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক চর্চা পরিবর্তন করতে হলে দলগুলোকে নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতে হবে: আমার রাজনৈতিক পুঁজি কি জনস্বার্থের জন্য, নাকি ব্যক্তিগত রিটার্নের জন্য? যতদিন এই প্রশ্নের সৎ উত্তর আসবে না, ততদিন প্রকৃত পরিবর্তনের আশা করা কঠিন।'
