তাজরীন অগ্নিকাণ্ড: ১৩ বছরেও শেষ হয়নি বিচারপ্রক্রিয়া
২০১২ সালের আজকের (২৪ নভেম্বর) এই দিনে ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস গার্মেন্টস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ১১২ জন শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান এবং আহত হন আরও অর্ধশতাধিক কর্মী।
আগুনের ঘটনার পরদিন আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক খায়রুল ইসলাম যে মামলা দায়ের করেছিলেন, তা এখনো কার্যত থমকে আছে। তালিকাভুক্ত ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে হাজির হয়েছেন মাত্র ১৬ জন। একের পর এক শুনানি পিছিয়েছে, নেই অগ্রগতিও। আগামী ৯ মার্চ পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে—এখনও ৮৮ জন সাক্ষীর জবানবন্দি বাকি।
ভুক্তভোগীদের দুর্দশা, অনিশ্চিত বিচার
বিচারের আশায় থাকতে থাকতে হতাশ হয়ে পড়েছেন এই পোশাক কারখানার আহত শ্রমিকরা। অনেকেই অঙ্গ হারিয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। আহত–নিহত পরিবারের সদস্যরাও চাইছেন ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন।
তেরো বছর আগের ভয়াবহ সেই দিনের কথা স্মরণ করে পঙ্গুত্ববরণকারী রেহানা বেগম টিবিএসকে বলেন, "কত কষ্টে আছি বলে বোঝানো যাবে না। দুবেলা ডাল–ভাতও জোটে না। গ্রামে যদি জমি-জমা থাকত, সেখানেই চলে যেতাম। যে সামান্য জমি ছিল, তা বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছি। ১৩ বছর হয়ে গেল, বিচার এখনো পেলাম না। এখন আমরা ক্ষতিপূরণ চাই।"
ঘটনায় আহত আরেক ভুক্তভোগী জরিনা খাতুন বলেন, "আমি অসুস্থ মানুষ, কষ্টের শেষ নেই। ১৩ বছর হয়ে গেল বিচার পেলাম না, পুনর্বাসনও হয়নি। কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই আমাদের। আমরা বিচার চাই, ক্ষতিপূরণ চাই।"
সেদিনের ভয়াবহতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, "গেটম্যান আল-আমিন কেন গেটে তালা লাগাল—আজও বুঝি না। অনেকে বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়েছিল। আমিও লাফ দিই। বাঁচার আশায় নয়—আগুনে পুড়ে মরলে লাশটাও পাওয়া যেত না। লাফ দিলে অন্তত পরিবার লাশটা পাবে। এ ভেবেই লাফ দিয়েছিলাম। সেই লাফে বেঁচে গেলেও এখন সবার কাছে বোঝা হয়ে আছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, সেদিন আগুনে মরলেই হয়তো ভালো হতো।"
আটকে আছে বিচার
মামলাটি কেন বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর জেএম ফরিদুর রহমান বলেন, "এটি মানবসৃষ্ট হত্যাকাণ্ড, এর বিচার হওয়া উচিত। বিগত সময়ে কী কারণে মামলাটি বিলম্বিত হয়েছে, আমরা তা জানি না। সাক্ষীদের আদালতে হাজির করানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু অনেকে অর্থ ও সময়ের কারণে আসতে চান না।"
অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন ভিন্ন কথা। আসামিপক্ষের আইনজীবী রোকেয়া বেগম বলেন, "সাক্ষীদের সমন দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তারা ঠিকমতো আদালতে হাজির হচ্ছেন না। ১০৪ জন সাক্ষীর কেউই সঠিকভাবে বক্তব্য দিতে পারছেন না। কেউ ঘটনাবলী জানেন না। এটি একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা ছাড়া কিছু নয়। কারা ঘটিয়েছে বা কার নির্দেশে হয়েছে—এমন কোনো প্রমাণ এখনো নেই।"
আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী শ্রী প্রাণ নাথ বলেন, "মামলাটি বহুদিন ধরে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে। যেসব সাক্ষী এসেছেন, তারা কেউ আসামিদের চিনতে পারেননি। অনেকেই ঘটনা ভুলে গেছেন। সুনির্দিষ্টভাবে কোনো আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য নেই। এখানে আসামিরাও ক্ষতিগ্রস্ত। জেনে–বুঝে কেউ এমন কাজ করবেন না যে নিজেরই বড় ক্ষতি হয়। আশা করি, আসামিরা ন্যায়বিচার পাবেন।"
মামলার অন্যতম প্রধান আসামি কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসেন টানা দুই দফা শুনানিতে আদালতে হাজির হননি। আইনজীবীরা দাবি করছেন, তিনি "অসুস্থ", যদিও এ বিষয়ে কোনো নথি জমা দেওয়া হয়নি। শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, তিনি দেশ ছাড়িয়ে পালিয়েছেন।
যে আগুন কখনোই নেভার নয়
দুর্ঘটনার ব্যাপ্তি এখনো শিউরে ওঠার মতো। সেদিন রাতে কারখানায় ছিলেন ৯৮৪ জন শ্রমিক। মারা যান ১২০ জন। তাদের মধ্যে ৫৮ জনকে শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়েছিল। বাকি ৫৩ জন এতটাই দগ্ধ হয়েছিলেন যে শনাক্ত না করেই তাদেরকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আগুনের এক বছর পর কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসেনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি। অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে 'অপরাধজনক নরহত্যা' এবং 'অবহেলার কারণে মৃত্যু'-এর অভিযোগ আনা হয়।
মামলায় অন্য অভিযুক্তরা হলেন—চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, মো. শামীম মিয়া, স্টোর ইনচার্জ (থ্রেড) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লালু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার এম মাহবুবুল মোরশেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা (আনোয়ারুল), ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর এবং শহিদুজ্জামান দুলাল।
আল আমিন, রানা, শামীম এবং মোবারক হোসেন এখনো পলাতক; বাকিরা জামিনে রয়েছেন।
তদন্তে নিশ্চিত হয়, ভবনটিতে কোনো জরুরি নির্গমনপথ ছিল না, নকশায়ও ছিল গুরুতর ত্রুটি। আরও জানা যায়, নিরাপত্তাকর্মীরা সেদিনের আগুনকে 'অগ্নিনির্বাপণ মহড়া' দাবি করে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেন। ধোঁয়া ও তালাবদ্ধ দরজার ফাঁদে আটকে অনেকে লাফ দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ পাননি।
এদিকে, শ্রমিকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের নেতারা কাজ করছেন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সবুজ টিবিএসকে বলেন, "আমরা নিয়মিত আদালতে উপস্থিত থেকে বিচার পর্যবেক্ষণ করছি। আগের মতোই এখনো বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীরা যথাযথভাবে কাজ করছেন না বলেও মনে হচ্ছে।"
তেরো বছর পেরিয়ে গেছে। কারখানার ধোঁয়াও মিলিয়ে গেছে—কিন্তু বেঁচে ফেরা মানুষের জীবনে তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ক্ষত রয়ে গেছে এখনো। তাদের কাছে এই ট্র্যাজেডি কখনোই শেষ হয়নি; শরীর, মন ও জীবনের প্রতিটি প্রান্তে তারা এখনও সেই দগ্ধ যন্ত্রণাই বহন করে চলেছেন।
