দিল্লিতে দুই নিরাপত্তা উপদেষ্টার বৈঠক: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বরফ কি গলছে তবে?
নয়াদিল্লিতে গত ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) খলিলুর রহমান এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের মধ্যকার বৈঠকটি নানা কারণে কূটনৈতিক মহলে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করার ঠিক একদিন পরেই এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়ত, আদালতের রায়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হাসিনাকে দেশে ফেরানোর জোর দাবি জানিয়ে একটি বিবৃতি দেয়। পরিহাসের বিষয় হলো, এই দাবিটি জানানো হয়েছে ২০১৩ সালে হাসিনার শাসনামলেই স্বাক্ষরিত একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় এবং এতে ব্যবহৃত ভাষা ছিল অত্যন্ত কড়া।
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই ঝাঁঝালো বিবৃতিটির দিকে নজর দেওয়া যাক। এতে বলা হয়, 'মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত এই ব্যক্তিদের যদি অন্য কোনো দেশ আশ্রয় দেয়, তবে তা হবে অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ আচরণ এবং ন্যায়বিচারের প্রতি চরম অবজ্ঞা।' ভারত অবশ্য এই বক্তব্যের সরাসরি কোনো জবাব দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। এমনকি আইসিটি'র রায়ের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে দুই প্যারাগ্রাফের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, তা ছিল অত্যন্ত সংযত ও সতর্ক।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই বিবৃতিতে বলা হয়, 'ভারত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংক্রান্ত রায়টি লক্ষ্য করেছে। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারত সবসময়ই বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ—যার মধ্যে রয়েছে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতা—তার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই লক্ষ্যে আমরা সকল অংশীজনের সাথে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকব।'
ঠিক এই জটিল প্রেক্ষাপটেই ১৯ নভেম্বর খলিলুর রহমান এবং অজিত দোভালের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। যদিও খলিলুর রহমানের দিল্লি সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের নেতৃত্বে আয়োজিত 'কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ' (সিএসসি)-এর বৈঠকে যোগ দেওয়া; কিন্তু পরদিন দুই দেশের এনএসএ'র দ্বিপাক্ষিক বৈঠকটি সেই বহুপাক্ষিক আয়োজনকেও ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।
হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কড়া বিবৃতিতে নয়াদিল্লি অসন্তুষ্ট হতে পারত এবং সেই জেরে দুই এনএসএ-র বৈঠকটি বাতিলও করতে পারত। কিন্তু তা ঘটেনি। কেন? এই ঘটনাকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম 'দ্য প্রিন্ট' 'ব্রেকিং দি আইস' [সম্পর্কের বরফ গলা] এবং 'ফ্রন্টলাইন' ম্যাগাজিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের 'রিসেট' [নতুন সূচনা] হিসেবে অভিহিত করতে চাইছে, যা বেশ লোভনীয় ব্যাখ্যা বলেই মনে হয়।
দুই এনএসএ'র বৈঠকে আসলে কী আলোচনা হয়েছে? নয়াদিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে জানিয়েছে, খলিলুর রহমান ও অজিত দোভালের মধ্যে 'গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বিষয়াবলি' নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ভারতের পক্ষ থেকেও বৈঠক নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা হয়নি। আইসিটি'র রায়ের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কড়া বিবৃতির কারণে বৈঠকের আলোচ্যসূচি নিয়ে জল্পনা তাই আকাশচুম্বী হয়েছে।
পরদিন (২০ নভেম্বর) সিএসসি সম্মেলনে খলিলুর রহমানের দেওয়া বক্তব্য থেকেই বাংলাদেশের মনোভাব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। তার বক্তব্যের দুটি প্রধান দিক ছিল: (১) সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ যেভাবে 'ভুল তথ্য ও অপপ্রচার' -এর শিকার হচ্ছে তা তুলে ধরা, এবং (২) বাংলাদেশ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল বা এর কোনো অংশে বাইরের বা অভ্যন্তরীণ কোনো শক্তিকে জনগণের নিরাপত্তা ও কল্যাণ বিঘ্নিত করতে দেবে না।
প্রথম দফাটি মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলা, যারা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশের অতিরঞ্জিত খবর নিয়ে ক্ষুব্ধ। দ্বিতীয় দফাটির মাধ্যমে ভারত থেকে উদ্ভূত নিরাপত্তা উদ্বেগ নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছে। ভারতে নিজের প্রথম সফর এবং ভারতীয় নিরপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশের এনএসএ-র এই বক্তব্য ছিল একটি সতর্ক কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস।
তবে এই বৈঠকটি কি কেবলই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি এটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ অব্যাহত রাখার জন্য যথেষ্ট; সেটি সময়ই বলে দেবে।
ঢাকায় ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের যে শীতলতা তৈরি হয়েছে, তাতে এখনই সুড়ঙ্গের শেষে আলো খোঁজা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, গত ৩ এপ্রিল ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ড. ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বৈঠকের পর বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক একে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য 'ইতিবাচক লক্ষণ' হিসেবে অভিহিত করতে কতটা তড়িঘড়ি করেছিল।
দুই নেতার সেই প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎকে ঢাকার কেউ কেউ সম্পর্কের উন্নতির চিহ্ন হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো, পরবর্তী মাসগুলোতে সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে। যখন শীর্ষ নেতারা সম্পর্কের এই পতন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন, তখন দুই এনএসএ সফল হবেন; এমন আশা করা কি খুব বেশি হয়ে যায় না? বর্তমান পরিস্থিতি এটিই প্রমাণ করে যে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন এমন এক জটিলতায় আটকে আছে যা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সহজ পথ নেই।
২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি বলেন, 'প্রতিবেশী দেশটি আবারও "রাজনৈতিকভাবে চরম মেরুকরণের" শিকার হয়েছে। দেশটির স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য বিষয়টি মোটেই শুভলক্ষণ নয়। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে এই বিভাজন আরও তীব্র আকার ধারণ করতে যাচ্ছে।'
ভারতের আরেক সাবেক কূটনীতিক রাজীব ডোগরা বলেন, 'বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা অতীতে বিভিন্ন সময়ে "উসকানিমূলক" বক্তব্য দিয়েছেন। দেশটিতে যেহেতু নির্বাচন আসন্ন, তাই ভবিষ্যতের জন্য এসব বিষয় ইতিবাচক বার্তা দেয় না।' তিনি সতর্ক করে বলেন, 'বাংলাদেশ আবারও 'চরমভাবে রাজনৈতিক মেরুকরণের' মধ্যে পড়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।'
অন্যদিকে, ভারতের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়াত মন্তব্য করেন যে, রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত বাংলাদেশ আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। আর এমন পরিস্থিতি ভারত কিংবা এই উপমহাদেশ; কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।
বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন এবং দেশটিতে ভারতের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা নেতিবাচক মনোভাবের কারণে আগামীতে সম্পর্ক আরও জটিল হওয়ার সব ইঙ্গিতই মিলছে। গত ৩১ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে এক সেমিনারে অজিত দোভাল মন্তব্য করেছিলেন যে, গত সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তনের পেছনে মূল কারণ ছিল 'দুর্বল শাসনব্যবস্থা'।
কারো কারো মতে, দোভালের এই মন্তব্য হাসিনাবিহীন বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নেওয়া এবং নির্বাচনের পর যে নতুন সরকার বা ব্যবস্থা আসবে, তাদের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে নয়াদিল্লির প্রথম ইঙ্গিত হতে পারে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারত নানা সময়ে ঢাকায় আওয়ামী লীগ ছাড়াও অন্য সরকারের সঙ্গেও কাজ করা শিখেছে। ভারত এইচ এম এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। তবে এটিও সমান সত্য যে, তাদের সঙ্গে ভারতের স্বাচ্ছন্দ্যের মাত্রা ভিন্ন হওয়ায় সেই সম্পর্কের গুণগত মানও ছিল আলাদা।
