মালয়েশিয়ার নতুন অভিবাসন শর্তে পুরোনো সিন্ডিকেট সক্রিয় হওয়ার আশঙ্কা
বিদেশী কর্মী নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য মালয়েশিয়ার সর্বশেষ নিয়োগসংক্রান্ত শর্তাবলী বাংলাদেশের শ্রমবাজারে একসময় আধিপত্য বিস্তারকারী পুরনো 'সিন্ডিকেট' ব্যবস্থাকে আবারও সক্রিয় করতে পারে বলে অভিযোগ উঠেছে।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, মালয়েশিয়ার ১০টি নতুন বাধ্যতামূলক শর্ত নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণকে কার্যকরভাবে গুটিকয়েক প্রভাবশালী অপারেটরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে, যা বাজারে নতুন করে একচেটিয়া আধিপত্য সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি করেছে।
এজেন্সিগুলো আশঙ্কা করছে, এই 'অযৌক্তিক শর্তাবলী' পূরণ করতে গেলে তাদের পরিচালন ব্যয় বাড়বে— যার ফলে অভিবাসন খরচ বেড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকায় পৌঁছাতে পারে।
নেপাল মালয়েশিয়ার নতুন আবশ্যিক শর্তাবলী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করলেও, বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে একটি দ্বিচারী ভূমিকা পালনের অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রণালয়টি একদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানানোর আশ্বাস দিচ্ছে, অন্যদিকে একই সাথে এজেন্সিগুলোকে প্রয়োজনীয় 'গুড কন্ডাক্ট সার্টিফিকেট' প্রদান করছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে প্রায় ২৮২টি বাংলাদেশি এজেন্সি এই ধরনের সনদ পেয়েছে।
কর্মী নিয়োগের জন্য মালয়েশিয়া সরকারের নির্ধারিত ১০টি শর্তের মধ্যে চারটি শিথিল করে বিএমইটি নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে আবেদন গ্রহণ করেছে। যারা সনদ সংগ্রহ করেছে, তাদের মধ্যে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত এবং পূর্ববর্তী মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত নিয়োগকারী সংস্থাও রয়েছে। সমালোচনার মধ্যেই এই সনদপ্রাপ্ত এজেন্সিগুলোর কয়েকটিকে গতকাল মন্ত্রণালয়ে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়েছিল এবং বাকিদের আজ সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে।
মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২৮ অক্টোবর কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাঠানো একটি চিঠির মাধ্যমে প্রবর্তিত নতুন মানদণ্ড অনুযায়ী, এজেন্সিগুলোর কমপক্ষে পাঁচ বছরের বৈধ লাইসেন্স, গত পাঁচ বছরে ৩,০০০ বিদেশী কর্মী ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা, কমপক্ষে তিনটি দেশে কর্মী পাঠানোর অভিজ্ঞতা, একটি 'গুড কন্ডাক্ট সার্টিফিকেট', জোরপূর্বক শ্রম বা পাচারের কোনো রেকর্ড না থাকা, একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মালিকানা এবং কমপক্ষে তিন বছর ধরে ১০,০০০ বর্গফুটের একটি স্থায়ী অফিস থাকা প্রয়োজন।
বর্তমানে একটি বিএমইটি লাইসেন্স নবায়ন করতে একটি এজেন্সিকে বছরে কমপক্ষে ২০০ জন কর্মী পাঠাতে হয় এবং ন্যূনতম ৬০০ বর্গফুটের অফিস থাকতে হয়।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় অনুসারে, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান এবং মিয়ানমারের এজেন্সিগুলোকে এই একীভূত মানদণ্ড অনুসরণ করে নির্বাচন করা হবে।
মালয়েশিয়া বাংলাদেশকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে এই মানদণ্ড পূরণকারী যোগ্য এজেন্সিগুলোর একটি তালিকা জমা দিতে বলেছে।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ৪ নভেম্বর এক চিঠিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে আগ্রহী নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর আরোপিত ১০টি শর্তের মধ্যে অন্তত তিনটি শিথিল করার জন্য মালয়েশিয়াকে অনুরোধ করেছেন।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের ব্যক্তিগত সচিব শওকত আলী টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে অন্তত ৩,০০০ বিদেশী কর্মী ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা, একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মালিকানা এবং গত তিন বছর ধরে কমপক্ষে ১০,০০০ বর্গফুটের একটি স্থায়ী অফিস বজায় রাখার শর্তগুলো থেকে অব্যাহতি চেয়েছে।'
শর্ত শিথিলের জন্য চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি এজেন্সিগুলোকে মালয়েশিয়ার শর্তের ভিত্তিতে সনদ দেওয়া হচ্ছে কেন— এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমাদের একই সাথে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। মালয়েশিয়ার প্রতিক্রিয়া কী হবে তা আমরা এখনো জানি না।'
খরচ ও সিন্ডিকেটের অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ
বাংলাদেশের নিয়োগকারী সংস্থাগুলো যুক্তি দিচ্ছে, এই শর্তগুলো অবাস্তব এবং ব্যতিক্রমী। তারা সতর্ক করেছে, এগুলো মেনে চলতে গেলে কর্মীদের অভিবাসন খরচ অতিরিক্ত বাড়বে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেন, 'গত তিন বছরে কর্মীরা সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ লাখ টাকায় মালয়েশিয়া গিয়েছে। কিন্তু যদি এজেন্সিগুলোকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করতে এবং ১০,০০০ বর্গফুটের অফিস রক্ষণাবেক্ষণ করতে বাধ্য করা হয়, তবে তাদের খরচ অনেক বাড়বে— এবং তারা নিশ্চিতভাবে সেই বোঝা কর্মীদের ওপর চাপিয়ে দেবে।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, 'আমার আশঙ্কা, খরচ ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।'
এর আগে ১০০-এজেন্সির সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন বায়রার সদস্য আলতাব খান। তিনি বলেন, '১ শতাংশ এজেন্সিও এই অযৌক্তিক শর্ত পূরণ করতে পারবে না। কেউ কেউ ইতোমধ্যে সনদ পাওয়ার জন্য ভুয়া অফিস দেখাচ্ছে।'
গত পাঁচ বছরে ৩,০০০ কর্মী পাঠানোর শর্তের কথা উল্লেখ করে আলতাব বলেন, 'শুধুমাত্র সিন্ডিকেট-সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোই বছরে এক হাজার কর্মী পাঠাতে পারত।'
তিনি অভিযোগ করেন, যারা একটি সিন্ডিকেট গঠন করতে চায়, তাদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েই এই শর্তগুলো আরোপ করা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ার নাগরিক আমিন নূরকে এর মূল হোতা হিসেবে দায়ী করেন।
তবে বায়রার সাবেক মহাসচিব এবং পূর্ববর্তী ১০০-এজেন্সির সিন্ডিকেটের সদস্য শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান নতুন করে সিন্ডিকেট গঠনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'এটি কোনো সিন্ডিকেট নয়।' তিনি বলেন, 'মালয়েশিয়া বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশের জন্য অভিন্ন মানদণ্ড চালু করেছে। বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে নয়।'
নোমান আরও বলেন, 'সরকার যদি কিছু শর্ত শিথিল করে, তবে আরও বেশি এজেন্সি অংশ নিতে পারবে এবং কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া সুন্দরভাবে এগিয়ে যাবে।'
যেসব এজেন্সি পূর্বে পুরোনো মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটের অধীনে ছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে আইনি মামলা ছিল, তাদের পুনরায় 'গুড কন্ডাক্ট সার্টিফিকেট' দেওয়ার বিষয়ে বিএমইটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'এজেন্সিগুলোর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা সনদ দিয়েছি, যতক্ষণ তারা মালয়েশিয়ার নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করে। এখন মন্ত্রণালয় আরও যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে।'
মন্ত্রণালয়ের দ্বিচারী অবস্থান
২৯ অক্টোবর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, তারা মালয়েশিয়াকে মানদণ্ড পূরণকারী সকল বাংলাদেশি এজেন্সিকে তালিকাভুক্ত করার জন্য অনুরোধ করবে। এজেন্সিগুলোকে নির্ধারিত কাগজপত্রসহ ৭ নভেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়েছিল।
তবে, ৩ নভেম্বর বায়রার সাবেক নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আশ্বাস দেন যে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার শর্তগুলোর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানাবে।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং সচিব নেয়ামত উল্লাহ ভুঁইয়ার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।
বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশিক্ষণ) এবং বায়রার প্রশাসক মো. আশরাফ হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'নিয়োগকারী সংস্থাগুলো এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের মতামত তুলে ধরেছে। শ্রমবাজারের জন্য যা সবচেয়ে ভালো, সরকার তাই করবে।'
বায়রার সদস্য আলতাব মন্ত্রণালয়ের অবস্থানের সমালোচনা করে বলেন, 'মন্ত্রণালয় যদি শর্ত শিথিল করে সনদ দিয়েই থাকে, তাহলে আবার মালয়েশিয়াকে চিঠি লিখল কেন?'
অবাস্তব দাবি
বায়রার সাবেক মহাসচিব নোমান এই মানদণ্ডগুলোকে 'অধিকাংশ বাংলাদেশি এজেন্সির জন্য অবাস্তব' বলে সমালোচনা করেছেন, বিশেষ করে ১০,০০০ বর্গফুটের অফিস এবং একটি নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তার শর্তটিকে।
তিনি বলেন, 'সরকার ইতোমধ্যে শতাধিক কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করে, যা দীর্ঘদিন ধরে কর্মীদের প্রস্তুতির জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।' তিনি আরও বলেন, 'এখন যদি প্রত্যেক এজেন্সিকে নিজস্ব কেন্দ্র তৈরি করতে হয়, তবে এই কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো অকেজো হয়ে পড়বে, খরচ বহুগুণে বেড়ে যাবে এবং এর বোঝা কর্মীদেরই বহন করতে হবে।'
কুয়ালালামপুর-ভিত্তিক স্বাধীন অভিবাসী অধিকার বিশেষজ্ঞ অ্যান্ডি হল 'গুড কন্ডাক্ট সার্টিফিকেট' এবং 'নৈতিক' সনদপত্রের প্রয়োজনীয়তাকে বিশেষভাবে সমস্যাজনক বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'যেকোনো কর্মী প্রেরণকারী দেশের পক্ষে বস্তুনিষ্ঠভাবে এই মানদণ্ডগুলো প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে।' তিনি বলেন, 'বাস্তবে এজেন্সিগুলো হয়তো দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে এই সনদগুলো পেতে পারে। পরিহাসের বিষয় হলো, সবচেয়ে বড় এজেন্সিগুলো— যারা সবচেয়ে বেশি কর্মী পাঠায়— তারাই প্রায়শই সবচেয়ে কম নৈতিক এবং সবচেয়ে বেশি শোষণকারী হয়। এই ঘটনাগুলো গভীরভাবে উদ্বেগজনক।'
