পোস্টারে ছেয়ে গেছে মেট্রোর পিলার থেকে ঢাকার দেয়াল, আইন ভেঙে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা
বাংলাদেশে দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণে আইন রয়েছে— এবং সেখানে শাস্তি ও জরিমানার বিষয়টিও স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, যারা খুব শিগগিরই জাতীয় সংসদে বসবেন এবং আইন প্রণয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবেন, সেই ভবিষ্যৎ সংসদ সদস্যদের একাংশ প্রকাশ্যে এই আইন অমান্য করছেন।
রাজধানীর বাংলামোটর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেল লাইনের প্রায় প্রতিটি পিয়ার এখন পোস্টারে ঢাকা। প্রতিটি স্তম্ভে ঝুলছে রাজনৈতিক নেতাদের মুখচিত্র—একজনের ওপর আরেকজনের পোস্টার, জায়গা দখলের প্রতিযোগিতায় ফিরে এসেছে পোস্টার সাঁটানোর সেই পুরনো সংস্কৃতি।
দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ এর ধারা-৪ এ বলা হয়েছে, এই আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা স্থান নির্ধারণ করে দিতে পারবে এবং উক্তরূপে নির্ধারিত স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে; কিন্তু শর্ত থাকে যে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে, উল্লিখিত নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোনো স্থানে বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত ও পদ্ধতিতে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে, দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে।
একই আইনের ধারা-৩ এ আরও বলা হয়েছে, 'ধারা ৪ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোনো স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে না।' যদি কেউ এ আইন ভঙ্গ করে, তবে তার বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন ৫ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে। অর্থদণ্ড অনাদায়ে সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। একই সঙ্গে ওই ব্যক্তিকে তার নিজের খরচে সংশ্লিষ্ট দেওয়াল লিখন বা পোস্টার মুছে ফেলার নির্দেশও দেওয়া যাবে।
অন্যদিকে, যদি কোনো কোম্পানি বা গোষ্ঠী আইনটির ৩ ও ৪ ধারার বিধান লঙ্ঘন করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন ১০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে। অনাদায়ে সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। একইভাবে, তাদেরও নিজ খরচে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার অপসারণের নির্দেশ দেওয়া যাবে।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশোধিত রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারে পোস্টার ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইসি সূত্র জানায়, দু-এক দিনের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধির গেজেট প্রকাশ করা হবে। নতুন বিধিমালায় বিগত নির্বাচনের তুলনায় বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আসছে। এরমধ্যে নির্বাচনি প্রচারে পোস্টার ও ড্রোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বিলবোর্ডে প্রচারের অনুমতি থাকবে—একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২০টি বিলবোর্ড ব্যবহার করতে পারবেন।
এদিকে বাংলামোটর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত বিভিন্ন দেওয়ালে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির নেতা শেখ ছালাউদ্দিন ছালু, বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টির এম এ মতিন ও কামাল হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের পক্ষ হতে তাদের ছবি সংবলিত পোস্টার ও ব্যানার টাঙানো রয়েছে। এর মাঝে দেখা যায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও বিটিভির 'নতুন কুঁড়ি' অনুষ্ঠানের পোস্টারও।
অথচ ভবন, পিলার রাস্তা-ঘাটে এসব ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টার টানানোর বিষয়ে নিয়ন্ত্রণের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে কার্যত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ঢাকা নগরীর সৌন্দর্য রক্ষা ও পরিচ্ছন্নতা বিধানে আইন থাকলেও, সিটি করপোরেশন নিজেই এই আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে না করতে পারায় শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন বাসিন্দারা।
ওই এলাকার নিয়মিত পথচারী গিয়াস উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন ঢাকার কোথাও তাকানোর মতো অবস্থা নেই। চারপাশে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের পোস্টার আর ব্যানার। এমনকি মেট্রোরেলের পিয়ারগুলোতেও এমনভাবে পোস্টার লাগানো হয়েছে, যেন মেট্রোরেল বানানো হয়েছে রাজনৈতিক প্রচারণার জন্য।"
"জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে করা গ্রাফিতির উপরেও তারা পোস্টার লাগিয়েছে। পরিচ্ছন্ন নগরের কথা সবাই মুখে বলে, কিন্তু বাস্তবে কেউ এগিয়ে আসে না," বলেন তিনি।
এই দৃশ্য শুধু বাংলামোটর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রাস্তার নয়—ঢাকার বিভিন্ন এলাকা এমনকি সারাদেশেই একই চিত্র। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা আইন অমান্য করে ব্যানার–পোস্টারে ছেয়ে ফেলেছেন শহর।
পোস্টারে ঢাকা পড়েছে ইসি ভবনের বাউন্ডারি
রাজধানীর কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, আগারগাঁও, মিরপুর, গুলশান, বনানী, মহাখালী, খিলগাঁও, পল্টন, প্রেসক্লাব, গুলিস্তান ও পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে—সবখানেই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের নামে ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন ঝুলছে। এমনকি আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনের বাউন্ডারিও এখন পোস্টারে ঢেকে গেছে। বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছবি সংবলিত পোস্টারই বেশি দেখা গেছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন পোস্টার সরানো আমাদের আইনে কাভার করে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধি কার্যকর হবে সিডিউল (তফসিল) ঘোষণার পর থেকে গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত। সিডিউল ঘোষণার পরও যদি রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীরা পোস্টার না সরায়, তাহলে নির্বাচন কমিশন নিজেরাই তা অপসারণ করবে।"
তিনি আরও বলেন, "আগামী ১৩ নভেম্বর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হবে, সেখানে এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচনা হবে। আমরা বলব, তারা যেন নতুন করে পোস্টার না লাগায় এবং সারাদেশে ইতোমধ্যে লাগানো পোস্টারগুলো যেন নিজেরাই সরিয়ে ফেলেন।"
"আমরা তাদের বলব, পরিবেশ ঠিক করুন, আপনারা পোস্টার লাগিয়েছেন, আপনারাই তুলুন। যদি না তোলেন, আমাদের হাতে তুললে বিষয়টি ভালো দেখাবে না," যোগ করেন তিনি।
আইনের প্রয়োগ করছে না সিটি করপোরেশন, পোস্টার তুলছে নিজ খরচে
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণে মাঠে নামলেও তারা আইন প্রয়োগ না করে নিজস্ব খরচে এই কাজ করছে।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন প্রয়োগ ছাড়া লাখ লাখ টাকা খরচ করে পোস্টার সরানো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান কার্যকর করা হলে অন্যরা তা থেকে শিক্ষা নিতো। এছাড়া যে হারে পোস্টার অপসারণ চলছে, সেটিও পর্যাপ্ত নয়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ৬ নভেম্বর বলেছেন, এক মাসে তারা প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করেছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. মাহবুবুর রহমান তালুকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অবৈধ ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারের বিরুদ্ধে আমাদের কার্যক্রম কিছুদিন বন্ধ ছিল। এখন আবার চারপাশে সয়লাব হয়ে গেছে, খুব দ্রুতই আমরা অপসারণে নামব।"
অপসারণ করলেও জরিমানা বা শাস্তির আওতায় কেন আনা হচ্ছে না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, "আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা কম, আর পোস্টার–ব্যানারের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়াটা কিছুটা জটিল। তাই আমরা মনে করি, তাদের পোস্টার নষ্ট হয়ে যাওয়াই আর্থিক ক্ষতি হিসেবে যথেষ্ট। ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।"
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, "বিদ্যমান আইনে পোস্টার লাগানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কিছুটা কঠিন। কারণ, ধরা পড়লে তারা বলে তাদের কর্মীরা উৎসাহিত হয়ে করেছে, তারা জানতেন না। এভাবে দায় এড়িয়ে যান। তাই প্রথমেই আইনে পরিবর্তন আনতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশে যেভাবে শহরের দৃষ্টিদূষণ ঘটছে, তা ভারতের মুম্বাইয়েও দেখা যায় না। শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সবাইকে সচেতন হতে হবে—নিজের শহর মনে করেই দায়িত্ব নিতে হবে।"
