উপরে অসমাপ্ত উড়ালসড়ক, আর নিচে অন্তহীন ভোগান্তি
বছরের পর বছর ধরে চলছে মুক্তারপুর–পঞ্চবটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। শুরুতে প্রকল্পটি এ অঞ্চলের মানুষের কাছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার আশার আলো হয়ে দেখা দিলেও এখন তা পরিণত হয়েছে দুর্ভোগের প্রতীকে। অব্যবস্থাপনা, ধীরগতি, সমন্বয়ের অভাব আর বর্ষা মৌসুমের প্রতিবন্ধকতা—সব মিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি সাধারণ মানুষের জন্য এক গলার কাঁটায় দাঁড়িয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জকে যুক্ত করা ১০ দশমিক ৩৭ কিলোমিটারের এই সড়কটি এখন নির্মাণস্থলের চেয়ে বেশি যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার মতোই দেখায়।
২০২০ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অক্টোবর এসে দেখা যাচ্ছে—উন্মুক্ত নর্দমা, গভীর গর্ত আর ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা নির্মাণবর্জ্য যেন ঝড়ের পরের বিধ্বস্ততার চিত্র তুলে ধরছে।
প্রতিদিন সকালে অফিসযাত্রী, কারখানা শ্রমিক আর ট্রাকচালকেরা মনে মনে প্রার্থনা করেন—বিপদ-আপদ ছাড়া যেন আজকের পথটা কোনোভাবে পাড়ি দিতে পারেন।
"সড়কে যানজট আর বিশৃঙ্খলা এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে গেছে," বলেন মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় যাতায়াতকারী আব্দুল্লাহ আল মাসুম। "আগে এক ঘণ্টায় পৌঁছানো যেত, এখন লাগে তিন ঘণ্টা বা তারও বেশি। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তায় কাদা–পানি জমে, জলাবদ্ধতা তৈরি হয়!"
উন্নত সংযোগ নয়, সড়ক যেন হয়ে উঠেছে শাস্তি!
মুক্তারপুরের কারখানা এলাকা থেকে ঢাকা ও দক্ষিণাঞ্চলে পণ্য পরিবহন সহজ করতে নির্মাণাধীন উড়ালসড়কটি এখন উল্টো বাণিজ্যের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পোশাক, সিমেন্ট ও হিমায়িত পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে প্রতিদিন ধুলা–বালি ও কাদামাখা রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে।
বিসিক শিল্পনগরীর এক মালিক বলেন, "আমাদের এক্সপোর্ট গার্মেন্টসের নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। কিন্তু সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে সময়মতো পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে খরচ বাড়ছে, আবার বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাছেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।"
তিনি আরও বলেন, "সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তাটি তলিয়ে যায়। পণ্যবোঝাই ট্রাক কাদায় আটকে পড়ে, অনেক সময় পণ্যও নষ্ট হয়।"
পোশাক কারখানার কর্মী সুমন বলেন, "ভোরে বের হয়ে সময়মতো অফিসে পৌঁছাতে পারি না। কাদা পেরিয়ে হেঁটে যেতে হয়। ফিরতি পথেও একই অবস্থা। বৃষ্টি হলে তো চলাই যায় না।"
অন্য এক গার্মেন্টস কর্মী রোকসানা বেগম বলেন, "গতকাল এক রিকশা উল্টে পড়ে আমার সহকর্মীর পায়ে সেলাই দিতে হয়েছে। এতো ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন অফিসে যাওয়া এখন মানসিক শাস্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে ধলেশ্বরী নদীর ওপর নির্মিত ষষ্ঠ বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সেতু উদ্বোধনের পর থেকে এর সংযোগ সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পঞ্চবটি–মুক্তারপুর সড়ক। এটি সংকীর্ণ (গড় প্রস্থ ৫.৫ মিটার) ও আঁকাবাঁকা। সড়কের দুই পাশে দোকানপাট ও বসতবাড়ি থাকায় প্রায়ই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে পাঁচটি সিমেন্ট কারখানা, ছয়টি হিমাগারসহ অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফলে ২৪ থেকে ৫০ টন পর্যন্ত ভারী যানবাহনের নিয়মিত চলাচলে সড়কটি প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। প্রকল্প এলাকায় বিসিক শিল্পাঞ্চল ও রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা থাকায় প্রতিদিন লক্ষাধিক শ্রমিক এই সড়ক ব্যবহার করেন।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ 'পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও দ্বিতল সড়ক নির্মাণ প্রকল্প' গ্রহণ করে। ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়।
বিলম্ব, ভোগান্তি আর ভবিষ্যতের আশা
মুন্সীগঞ্জ শহরের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, "মুক্তারপুর–পঞ্চবটি দ্বিতল সড়কটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, যা ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য। তবে এ ধরনের বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে জনগণের নিরাপত্তা ও চলাচলের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা একটি মৌলিক দায়িত্ব। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা সেই দায়িত্ব পালন করছে না। ফলে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কর্মজীবীরা ভোগান্তির মধ্যে কর্মস্থলে পৌঁছাচ্ছেন, শিল্পকারখানার মালিকেরা পণ্য পাঠাতে পারছেন না—ফলে সময় ও অর্থ দুইই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।"
নিয়মিত যাতায়াতকারী মুক্তারপুরের পান্না সিনেমা হলের মালিক আজগর হোসেন বলেন, "বর্তমানে সড়কের যে অবস্থা, তা উন্নয়নের নামে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার এক উৎসবে পরিণত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত কাজের গতি বাড়ানো, জনগণের দুর্ভোগ কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং সঠিক তদারকি নিশ্চিত করা।"
নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের মুন্সীগঞ্জ জেলা সভাপতি আতিকুর রহমান টিপু বলেন, "প্রকল্পটি শেষ হলে পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর হয়ে মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ভোলা ও খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলগামী যানবাহন সরাসরি এই পথে চলাচল করতে পারবে। ঢাকায় না ঢুকেই পণ্য ও যাত্রী পরিবহন অনেক সহজ হবে। এতে যানজট কমবে, পরিবহন ব্যয়ও হ্রাস পাবে।"
"তবে প্রকল্প চলাকালীন জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল কর্তৃপক্ষের। সেই ব্যবস্থা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে লাখো মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা," বলেন তিনি।
জানা গেছে, মুক্তারপুর–পঞ্চবটি ছয় লেন মহাসড়ক প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১০ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (দ্বিতল সড়ক) এবং বাকি অংশ অ্যাটগ্রেড ৪ থেকে ৬ লেনের রাস্তা। প্রকল্পে থাকবে র্যাম্প, ওজন স্টেশন, টোল প্লাজা, গোলচত্বর ও সংযোগ সড়ক।
প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা, পরে তা বাড়িয়ে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। প্রথমে মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত, তবে কাজের ধীরগতির কারণে তা বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান—স্যানডং লুকিয়াও গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড এবং স্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ—প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, "এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি প্রায় ৭৯ শতাংশ। নারায়ণগঞ্জের গোপচর এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত কিছু সমস্যা থাকায় সেখানে অগ্রগতি তুলনামূলক ধীর। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্প শেষ করতে দিন-রাত তিন শিফটে কাজ চলছে।"
