কারখানায় চরম তাপপ্রবাহ ও বায়ু চলাচলের অভাবে বাড়ছে শ্রমিকের অসুস্থতা, কমছে উৎপাদন: গবেষণা
চরম তাপপ্রবাহ, অপর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ও দীর্ঘ কর্মঘণ্টা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, চামড়া ও পাদুকা শিল্পের শ্রমিকদের অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে কমে যাচ্ছে উৎপাদনশীলতা ও রপ্তানি আয়; আর চাপ বাড়ছে জাতীয় অর্থনীতির ওপর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব খাতের ৮২ শতাংশ শ্রমিক তীব্র তাপজনিত মানসিক ও শারীরিক চাপের (হিট স্ট্রেস) শিকার।
তৈরি পোশাক, চামড়া ও পাদুকা শিল্প মিলিয়ে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮৩ শতাংশের বেশি আসে—যা জিডিপিতে অবদান রাখে ৮.৭৬ শতাংশ। এই খাতগুলো মিলিয়ে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান গড়ে উঠেছে।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশের কারণে শিল্পখাতজুড়ে উৎপাদনশীলতা ও কর্মদক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পোশাক খাতে ৬২.৭ শতাংশ শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কমেছে, আর চামড়া খাতে ৮৯.২ শতাংশ শ্রমিকের দক্ষতা হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে বহু কারখানা নির্ধারিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে—যেখানে পোশাক খাতে ৬৪.২ শতাংশ এবং পাদুকা খাতে ২০.৭ শতাংশ শ্রমিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেননি।
প্রধান গবেষক ড. মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তন তৈরি পোশাক, চামড়া ও পাদুকা শিল্পের শ্রমিকদের জীবিকা, স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। অতিরিক্ত গরম, দুর্বল বায়ু চলাচল ও তাপের চাপের কারণে শ্রমিকরা ত্বক ও শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, মাথাব্যথা এবং মানসিক চাপের শিকার হচ্ছেন।"
"উৎপাদন কমে গেলে ছাঁটাইয়ের আশঙ্কায় তারা সারাক্ষণ অনিশ্চয়তায় থাকেন। নারী শ্রমিকদের মধ্যেও পানি ও প্রজনন স্বাস্থ্য–সংক্রান্ত সমস্যা বাড়ছে," বলেন তিনি।
গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ঢাকার সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর ও হেমায়েতপুর শিল্পাঞ্চল থেকে। মোট ৭০০ জন শ্রমিকের (পোশাক: ৪০০, চামড়া: ১৫০, পাদুকা: ১৫০) ওপর জরিপ চালানো হয়েছে। পাশাপাশি ৪৪টি মূল তথ্যদাতা সাক্ষাৎকার (কেআইআই), ৭টি ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফজিডি) এবং ৮টি কেস স্টাডির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে এসব তথ্য।
শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সমস্যা
গবেষণায় অংশ নেওয়া এক নারী পোশাক শ্রমিক বলেন, "কারখানায় বাতাস ঠিকমতো আসে না। গরমে প্রতিদিনই কেউ না কেউ অজ্ঞান হয়ে যায়।"
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৪৯ শতাংশ শ্রমিক প্রতিদিন ৯ থেকে ১১ ঘণ্টা কাজ করেন, আর প্রায় এক-চতুর্থাংশ শ্রমিক কাজ করেন ১১ ঘণ্টারও বেশি। অতিরিক্ত গরম ও বদ্ধ পরিবেশে দীর্ঘ সময় কাজ করার কারণে ৪৯ শতাংশ শ্রমিক মাথাব্যথা, ত্বকের রোগ এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভোগেন।
চামড়া খাতে পরিস্থিতি আরও নাজুক। সেখানে নারী শ্রমিকদের মধ্যে প্রতি চারজনের একজন মাসিক অনিয়মে ভোগেন, আর প্রতি ছয়জনের একজন গর্ভপাতের ঝুঁকিতে আছেন।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইশিতা বিশ্বাস বলেন, "গার্মেন্ট শ্রমিকদের দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, গরম ও ভিড়ভাট্টা পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং অপুষ্টির কারণে ডিহাইড্রেশন, রক্তস্বল্পতা, মানসিক চাপ ও ঘুমের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। এতে শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে—ফলে কারখানার আয় ও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।"
তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতা রক্ষায় ন্যায্য মজুরি, সীমিত কর্মঘণ্টা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, বিশুদ্ধ পানি ও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এখন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতারও পূর্বশর্ত।
অভিবাসন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা
জরিপে দেখা গেছে, ৯১ শতাংশ শ্রমিক অভ্যন্তরীণ অভিবাসী। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশেরও বেশি জলবায়ু–জনিত কারণে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছেন।
তবে শহরে এসে শুরু হয়েছে তাদের নতুন লড়াই। অতিরিক্ত ভাড়া, গাদাগাদি ঘর, কম মজুরি ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে লড়াই করছেন তারা।
একজন শ্রমিক বলেন, "বন্যা হলে গ্রামের ফসল নষ্ট হয়, তখন বাজারে দাম বাড়ে। কিন্তু আমাদের মজুরি তো একই থাকে।"
শিল্পের প্রস্তুতি দুর্বল
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের মাত্র এক–তৃতীয়াংশ কারখানায় বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে, আর পর্যাপ্ত পানি ব্যবস্থাপনা রয়েছে ২০ শতাংশেরও কম কারখানায়। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করছে মাত্র ১৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠান।
অন্যদিকে, ৪০ শতাংশের বেশি শ্রমিক কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নেই, আর স্বাস্থ্যবীমা সুবিধা পাচ্ছেন মাত্র ১০ শতাংশ শ্রমিক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে শুধু শ্রমিক নয়, পুরো রপ্তানি আয়ই ঝুঁকিতে পড়বে। এক শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞ বলেন, "শ্রমিকরা অসুস্থ হলে কারখানার উৎপাদন কমে যায়, অথচ শিল্পের চাকা তাদের পরিশ্রমেই ঘোরে।"
সাভারের এক কারখানা মালিক টিবিএস-কে বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়তি তাপমাত্রা শ্রমিকদের জন্য কর্মপরিবেশকে অসহনীয় করে তুলছে। এতে একদিকে তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে উৎপাদনশীলতাও কমে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি গবেষণার সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে, যাতে উৎপাদন বাড়ানো যায়।"
ন্যায্য রূপান্তর বিষয়ে অজ্ঞতা
'ন্যায্য রূপান্তর' (জাস্ট ট্রানজিশন)—অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মধ্যেও শ্রমিকদের নিরাপদ ও টেকসই জীবিকা নিশ্চিত করার ধারণা—সম্পর্কে শ্রমিকদের জ্ঞান এখনো খুবই সীমিত।
তবে তারা এটিকে আশার পথ হিসেবে দেখছেন। জরিপে শ্রমিকদের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে: উচ্চ মজুরি (৭৪%), স্বাস্থ্যবীমা (৬৩%) এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ (৫৭%)।
নীতি ও পদক্ষেপের আহ্বান
প্রধান গবেষক ড. মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় মালিকপক্ষ, ব্র্যান্ড ও ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। কারখানায় আরামদায়ক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং 'জাস্ট ট্রানজিশন'-এর মাধ্যমে যেন কোনো শ্রমিক কর্মহীন বা বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।"
"সরকারকে নীতিগত প্রণোদনা ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি শ্রমিকদের দক্ষতা ও অভিযোজন ক্ষমতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি," যোগ করেন তিনি।
