কার্বন নিঃসরণ কমাতে শতভাগ রিফাইন্ড স্টিল উৎপাদনের আহ্বান বিশেষজ্ঞদের
দেশের স্টিল খাতকে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই করতে পরিশোধিত স্টিল ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার, ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি গ্রহণ এবং বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে বাস্তবায়ন অপরিহার্য বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের মোট কার্বন নিঃসরণের প্রায় ১০ শতাংশ আসে স্টিল শিল্প থেকে। খাতটির কিছু প্রতিষ্ঠান নিঃসরণ কমাতে উদ্যোগ নিলেও এসব প্রচেষ্টা এখনো সীমিত বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোববার (২৬ অক্টোবর) 'বাংলাদেশ স্টিল ইন্ডাস্ট্রি: ড্রাইভিং সস্টেইনেবিলিটি, সিসমিক রেজিলিয়েন্স, এন্ড অ্যাডভান্সড রিফাইন্ড স্টিল ফর ম্যাক্সিমাম কাস্টমার স্যাটিসফ্যাকশন' শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এসব কথা বলেন।
"আমাদের স্টিল শিল্প যদি সত্যিকার অর্থে টেকসই হতে চায়, তাহলে কেবল 'গ্রিন' (সবুজ) রঙ নয়, নীতিগত ও প্রযুক্তিগত সংস্কারই হতে হবে প্রথম পদক্ষেপ। 'গ্রিন' ব্র্যান্ডিং নয়, বরং প্রকৃত অর্থে টেকসই উন্নয়নের পথে আসতে হবে," শনিবার ঢাকায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও আবুল খায়ের স্টিলের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে বলেন পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
টিবিএসের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ এডিটর শরিয়র খান পরিচালিত এই আলোচনায় বক্তারা বলেন, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু 'গ্রিন ব্র্যান্ডিং' নয়, প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা সংস্কার, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং শক্তিশালী জবাবদিহি কাঠামো।
অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে উপস্থাপিত দুটি কী–নোট প্রবন্ধে প্রযুক্তি ও নীতিগত দিক থেকে আরও সবুজ, নিরাপদ ও শক্তিশালী স্টিল শিল্প গড়ে তোলার সম্ভাবনাকে তুলে ধরা হয়।
বুয়েটের মেটেরিয়ালস অ্যান্ড মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল ইসলাম 'শিফট ফ্রম লো-স্ট্রেংথ টু হাই-স্ট্রেংথ স্টিল ক্যান হেল্প ইন বিল্ডিং এ স্ট্রং অ্যান্ড গ্রিন বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, ৪০০ গ্রেডের স্টিল থেকে ৫০০ গ্রেডে এবং ৩০ এমপিএ কংক্রিট থেকে ৬০ এমপিএ কংক্রিটে উন্নীত করা হলে কাঠামোর ওজন ২৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব, যা স্থায়িত্ব ও টেকসই দুটোই নিশ্চিত করবে।
আমিনুল ইসলাম টেকসই নকশার জন্য সাতটি মানদণ্ড তুলে ধরেন—যার মধ্যে ছিল মানসম্পন্ন উপকরণ, অনুপাতের সামঞ্জস্য এবং সিমেট্রি বা ভারসাম্য। তিনি জোর দিয়ে বলেন, "হালকা ওজনের উচ্চ-শক্তির কাঠামোই হবে ভবিষ্যতের বৈশ্বিক নির্মাণের পথ।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের প্রায় ১৮ শতাংশই আসে স্টিল ও সিমেন্ট শিল্প থেকে; তাই কম-কার্বন ও কার্যকর উৎপাদন নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান শামসুদ্দিন ইলিয়াস 'বাংলাদেশ স্টিল ইন্ডাস্ট্রি: নেভিগেটিং দ্য ফিউচার উইথ ইকো-ফ্রেন্ডলি সাসটেইনেবল অপারেশন, সিসমিক রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড ১০০% রিফাইন্ড স্টিল' শীর্ষক আরেকটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
তিনি স্টিল শিল্পে ম্যানুয়াল রি-রোলিং থেকে পরিশোধিত, স্বয়ংক্রিয় ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তরের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, "টেকসই স্টিল এখন পরিবেশের পাশাপাশি অর্থনীতির জন্যও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।"
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, যেন একটি জাতীয় রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়—যেখানে বিল্ডিং কোড হালনাগাদ, সরকারি প্রকল্পে বাধ্যতামূলকভাবে হাই-স্ট্রেংথ (শক্তিশালী) স্টিল ব্যবহার এবং সক্ষমতা উন্নয়নের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। যাতে করে বাংলাদেশ টেকসই ও কম-কার্বন নির্গমনকারী স্টিল উৎপাদনের একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম বলেন, "রিফাইন্ড স্টিল এবং উচ্চমানের স্টিল পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে পারলেই কোম্পানিগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেদিকে যাবে। স্টিল শিল্পের প্রায় ৭০ শতাংশই সরকারি প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুযায়ী আমরা এখনো ৫০০ গ্রেডের বেশি রড ব্যবহার করতে পারি না, যদিও কোম্পানিগুলো ৭০০ গ্রেড পর্যন্ত রড উৎপাদন করছে। আমরা জনবলকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি এবং সবুজ স্থাপনা নির্মাণের উপযোগী করে তুলছি। তবে বিএনবিসিতে পরিবর্তন না আনলে 'গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি' সম্ভব নয়।"
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও দ্য রানী রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. সুমন চৌধুরী বলেন, "বাংলাদেশের স্টিল শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন 'ক্যাপাসিটি'। বাজার বিশ্লেষণ না করেই সবাই বিনিয়োগ করেছে, ফলে উৎপাদনক্ষমতার বড় অংশ অব্যবহৃত পড়ে আছে। এখন যা আছে, সেটাকে সবুজ ও টেকসই করতে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে। চট্টগ্রাম ফোর্টকে আরও সক্রিয় করতে হবে, বিএনবিসি ও পিডব্লিউডিকে তাদের নীতিমালা পরিবর্তন করতে হবে এবং মানসম্পন্ন পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে।"
আবুল খায়ের গ্রুপের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ও লিগ্যাল বিভাগের গ্রুপ হেড শেখ শাবাব আহমেদ বলেন, "আমরা গ্রিন ইনিশিয়েটিভে বড় বিনিয়োগ করছি, কিন্তু সরকার নীতিমালা পরিবর্তন করে আমাদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিচ্ছে না। বিএনবিসি হালনাগাদ করে এই বিনিয়োগকে সুরক্ষা দেওয়া দরকার।"
তিনি আরও বলেন, "আবুল খায়ের দেশে প্রথম রিফাইন্ড স্টিল উৎপাদন করেছে। আমরা শতভাগ রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং করি, কোনো গ্রাউন্ডওয়াটার ব্যবহার করি না। সবুজায়নের অংশ হিসেবে আমাদের কারখানায় ৫০ মেগাওয়াটের সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৫ সালে আবুল খায়ের স্টিল দেশে প্রথমবারের মতো বিশ্বের সর্বাধুনিক ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি চালু করে। এর মাধ্যমে স্ক্র্যাপ লোহা গলিয়ে বিলেট তৈরি হয়, ফলে কারখানার দূষিত ধোঁয়া বাইরে ছড়ায় না।"
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব (ভ্যাট নীতি) মো. মশিউর রহমান বলেন, "স্টিল শিল্প শুধু অর্থনীতির নয়, আমাদের সভ্যতার বিবর্তনের প্রতীক। প্রস্তর যুগ থেকে লোহা যুগ—প্রতিটি ধাপেই আমরা অস্ত্র নয়, আত্মরক্ষার উপায় খুঁজেছি। আজও স্টিলের উন্নয়ন মানে আমাদের টেকসই আত্মরক্ষা ও উন্নয়নের কাঠামো গড়ে তোলা।"
তিনি আরও বলেন, "বর্তমানে স্টিল শিল্পকে আরও রিফাইন ও আধুনিক করা মানে হচ্ছে পরিবেশবান্ধব, শক্তিশালী এবং ভবিষ্যতমুখী বাংলাদেশ গড়ে তোলা। রিফাইনমেন্ট শুধু ধাতুর নয়, নীতিরও প্রয়োজন আছে। যেমন স্টিল পরিশোধনের মাধ্যমে শক্তি ও স্থায়িত্ব বাড়ে, তেমনি নীতির পরিশুদ্ধতা আসে স্পষ্টতা, স্বচ্ছতা ও পূর্বনির্ধারিততার মাধ্যমে। আমাদের রাজস্বনীতি এখন 'মিড ও লং টার্ম' ভিশনে যাচ্ছে, যাতে শিল্প উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিতে পারেন। আমরা চাই, প্রতিটি নীতিতে পূর্বানুমানযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা বজায় থাকুক।"
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান বলেন, "এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে মুনাফাকে অগ্রাধিকার দেব? পাহাড় কেটে, দূষিত স্ক্র্যাপ আমদানি করে বা অপ্রয়োজনীয় নির্মাণ করে আমরা নিজেদের অস্তিত্বই ঝুঁকির মুখে ফেলছি। এখন প্রয়োজন একটি জাতীয় রোডম্যাপ, যেখানে নির্ধারিত থাকবে—২০৩০ বা ২০৩৫ সালের মধ্যে কীভাবে স্টিল শিল্প 'ক্লিনার, স্মার্টার, সেফ ও রেজিলিয়েন্ট' হবে।"
তিনি আরও বলেন, "স্টিল উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার কেবল খরচ কমাবে না, বরং বাংলাদেশকে 'গ্রিন স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং'-এর আঞ্চলিক নেতৃস্থানীয় অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে ইএসজি (Environmental, Social, Governance) মানদণ্ড পূরণ করা ছাড়া বিকল্প থাকবে না।"
পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পি অ্যান্ড এসপি) মো. শামসুদ্দোহা বলেন, "স্টিল আমাদের উন্নয়নের অপরিহার্য অংশ, তবে এর সঙ্গে পরিবেশগত প্রভাবকেও বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের দেশে মোট কার্বন নিঃসরণের প্রায় ১০ শতাংশ আসে স্টিল শিল্প থেকে এবং ৮ শতাংশ সিমেন্ট খাত থেকে। এই দুই শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ও পুনঃব্যবহার (রিইউজ) ব্যবস্থা চালু করতে হবে।"
তিনি জানান, "সরকারি খাতে ১০০ শতাংশ নন-ফায়ার ব্রিক ব্যবহারে আমরা সফল হয়েছি। এখন প্রাইভেট সেক্টরেও এ উদ্যোগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশ বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ও বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) কার্যকর না হলে টেকসই নির্মাণ সম্ভব নয়। এখন সময় এসেছে কোডটি আপডেট করে ৫০০ গ্রেড থেকে ৭০০ গ্রেড পর্যন্ত নতুন মান সংযোজনের।"
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. শামীম বলেন, "ভূমিকম্পের সময় হাই-স্ট্রেংথ স্টিল কাঠামোর স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে স্টিলের শক্তির সঙ্গে কংক্রিটের সামঞ্জস্য না থাকলে নকশায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। আমরা এখন ৬০০০ পিএসআই পর্যন্ত কংক্রিট ব্যবহার করছি, কিন্তু স্টিলের মান বাড়লেও কংক্রিটের উন্নয়ন না ঘটলে কাঠামোগত ঝুঁকি থেকেই যাবে। তাই একই সঙ্গে স্টিল ও কংক্রিট—দুটোর মানোন্নয়ন জরুরি।"
জাহাজভাঙা শিল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমরা এখন সেই সেক্টরকে 'গ্রিন ইয়ার্ড'-এ রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছি। শুধু গাছ লাগানো নয়, শ্রমিক নিরাপত্তা ও ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করাই গ্রিন ইয়ার্ডের মূল লক্ষ্য। ইতোমধ্যে ছয় থেকে সাতটি প্রতিষ্ঠান এই মানদণ্ডে কাজ করছে।"
জিপিএইচ ইস্পাতের চিফ পিপল অফিসার শারমিন সুলতান জয়া বলেন, "২০২০ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় শিল্পখাত, বিশেষ করে স্টিল সেক্টরকে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে ইলেকট্রিক ফার্নেস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও স্ক্র্যাপ সার্কুলারিটি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।"
তিনি বলেন, "জিপিএইচ ইস্পাত ইতোমধ্যেই এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বৈপ্লবিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০২০ সালেই আমরা বিশ্বের অত্যাধুনিক কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (কিউ-ইএএফ) প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করি। এর মাধ্যমে প্রতি টন স্টিল উৎপাদনে ২৩৫ কেজি কার্বন সাশ্রয় সম্ভব হয়েছে।"
পিটাছড়া ফরেস্ট অ্যান্ড বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মাহফুজ রাসেল বলেন, "স্টিল শিল্পে ব্যবহৃত স্ক্র্যাপ ও স্ল্যাগের কোনো ডেটা নেই। যদি এসব তথ্য উপাত্ত থাকত, তাহলে পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজেই শনাক্ত করা যেত।"
ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, "স্টিল শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করার পাশাপাশি এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনমানের বিষয়টিও সমানভাবে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।"
অনুষ্ঠানে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, "স্টিল শিল্প এখনো বিশ্বের সবচেয়ে কার্বন-নির্ভর ও পরিবেশদূষণকারী শিল্পগুলোর একটি। স্টিল উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াই এত বেশি বিদ্যুৎ ও পানিনির্ভর যে একে সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব করা প্রায় অসম্ভব। আপনি চাইলেই এটিকে শূন্য কার্বনে নিয়ে যেতে পারবেন না। রিফাইন্ড স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং, সোলার এনার্জি ব্যবহার, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং, আর্ক ফার্নেস পদ্ধতি চালু, গ্রিন স্পেস সংরক্ষণ—এসব উদ্যোগ নিলে কার্বন নিঃসরণ কিছুটা কমানো সম্ভব, কিন্তু একে পুরোপুরি 'জিরো কার্বন' করা সম্ভব নয়।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা এখন খুব সহজেই কিছু রঙ করে বা সার্টিফিকেট নিয়ে সেটাকে 'গ্রিন' বলে দিই। কিন্তু শুধু কাগজে-কলমে সার্টিফিকেট পেলেই কোনো শিল্প টেকসই হয় না, যদি এর মূল কার্যক্রমের ধরণ না বদলায়।"
রিজওয়ানা হাসান বলেন, "বাংলাদেশে এখনো উন্নয়ন মানেই প্রকৃতিকে ধ্বংস করা। এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রকৃতিকে ব্যবহার করা আর ধ্বংস করা এক নয়। যে উন্নয়ন প্রকৃতিকে নষ্ট করে, সেটি কখনোই টেকসই উন্নয়ন নয়।"
তিনি সরকারের নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে বলেন, "সাসটেইনেবিলিটি শুধু কনফারেন্সে আলো জ্বালিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার বিষয় নয়—এটি আইন ও নীতিতে প্রতিফলিত হতে হবে। আইন ও নীতি যদি সৎ না হয়, তাহলে সব কিছুই শুধু 'গ্রিন' রঙে রাঙানো থাকবে, বাস্তবে কিছুই বদলাবে না।"
নগর পরিকল্পনার ঘাটতি নিয়ে সমালোচনা করে তিনি বলেন, "আমরা রাস্তার পাশে গাছ লাগাই, কিন্তু ভবিষ্যতে রাস্তা প্রশস্ত করার প্রয়োজন নিয়ে ভাবি না। পরে গাছ কেটে রাস্তা বাড়াতে হয়। শুরু থেকেই পরিকল্পনা থাকলে প্রকৃতি ও উন্নয়ন—দুটোই রক্ষা পেত। আমরা স্টিল, সিমেন্ট, ইটের কারখানা গড়ছি, কিন্তু প্রকৃতির রিসোর্স বেইস ধ্বংস করছি। এটা উন্নয়ন নয়, ধ্বংস।"
তিনি বলেন, "সাসটেইনেবিলিটি মানে শুধু টেকসই অর্থনীতি নয়, পরিবেশগত ভারসাম্যও বজায় রাখতে হবে। কেবল ব্যবসা টিকিয়ে রেখে সমাজকে টেকসই করা যায় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অক্সিজেন, পানি ও পরিবেশ রক্ষাই প্রকৃত সাসটেইনেবিলিটি।"
 
