ইসরায়েল-ফিলিস্তিন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়েও বেশি প্রাণহানি বাংলাদেশের সড়কে: যাত্রী কল্যাণ সমিতি

গত ১২ বছরে বাংলাদেশের সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ১ লাখ ১৬ হাজারেরও বেশি মানুষ; ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মিলিয়েও নিহতের সংখ্যার চেয়ে এটি বেশি বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির মতে, দুর্নীতি, অনিয়ম ও সরকারের ভুলনীতির কারণেই সড়ক আজ মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এই কথা বলেন সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
তিনি বলেন, '২০১৪ সাল থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ৬৭ হাজার ৮৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন নিহত এবং ১ লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন আহত হয়েছেন। হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী এই সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি হতে পারে।'
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, 'স্বাধীনতার আগে ৮০ শতাংশ মানুষ নৌ ও রেলপথে যাতায়াত করত। দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশনে একের পর এক সড়ক নির্মাণের নামে লুটপাট ও ভুলনীতি অনুসরণ করে এখন ৮০ শতাংশ মানুষ সড়কনির্ভর। ফলে দুর্ঘটনাও বেড়েছে ৮০ শতাংশ।'
তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'গত এক যুগে সড়ক পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধ চলাচল, লাইসেন্সবিহীন ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক, মাদকাসক্ত ড্রাইভার, সড়কের ত্রুটি— এসবই সড়ককে মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত করেছে। এক যুগের বেশি সময় সড়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ওবায়দুল কাদের পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সরকারের পরিবর্তনের পরও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগের নীতি পরিবর্তন না হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।'
তিনি আরো বলেন, 'বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থার উদ্যোগ না নিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধনের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তাতে অচিরেই ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর অচল হয়ে পড়বে।'
যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে ১২ দফা সুপারিশ পেশ করেছে।
১. হারিয়ে যাওয়া নৌপথ, রেলপথ ও সড়কপথের সাথে সমন্বয় করে সমন্বিত যাতায়াত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।
২. ঢাকা-চট্টগ্রামসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সরকারি উদ্যোগে ম্যাস ট্রানজিট (পাতাল মেট্রোরেল) ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. চাঁদাবাজি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম্য বন্ধে পরিবহনখাত আপাদমস্তক সংস্কার করতে হবে।
৪. আলাদা উন্নতমানের বাস লেইন চালু করতে হবে।
৫. সারাদেশে জেলা শহর থেকে উপজেলায় মানসম্পন্ন বাস নামিয়ে শক্তিশালী বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।
৬. ঢাকা-চট্টগ্রামসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সরকারি উদ্যোগে ডিজিটাল লেনদেনের ভিত্তিতে কমপক্ষে দুটি বাস র্যাপিড ট্রানজিট চালু করতে হবে।
৭. মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার আমদানি ও বিপণন বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
৮. উন্নত কারিকুলাম তৈরি করে পরিবহন চালকদের রাষ্ট্রের খরচে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
৯. উন্নত দেশের আদলে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম ডিজিটাল করতে হবে এবং ট্রাফিক ট্রেনিং একাডেমী গড়ে তুলতে হবে।
১০. সড়ক দুর্ঘটনার মামলা সরকারি উদ্যোগে আমলে নিতে হবে এবং প্রতিটি হতাহত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের আওতায় আনা হবে।
১১. পরিবহন সেক্টরে যাত্রীস্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতিটি ফোরামে যাত্রী প্রতিনিধি ও ভুক্তভোগীর মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
১২. সারাদেশে সাইক্লিস্ট ও পথচারীদের জন্য পৃথক লেইন ও নিরাপদ ফুটপাতের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সড়ক সেক্টরে আইনের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।