গণমাধ্যমকর্মীর মৃত্যু: যৌন নিপীড়ন তদন্ত ও পদক্ষেপে প্রশ্ন, ঢাকা স্ট্রিম সম্পাদককে ৫ নারীর চিঠি

রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে গতকাল (১৯ অক্টোবর) এক নারী গণমাধ্যমকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি যাত্রা শুরু করা নতুন অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা স্ট্রিমে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।
শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমাউল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) জানান, ওই নারীর পরিবারের লোকজন ঘরের দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। পুলিশ ওই হাসপাতাল থেকে গতকাল তার লাশ উদ্ধার করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। ময়নাতদন্তের পর বলা যাবে, তার মৃত্যু কীভাবে হয়েছে।
তবে তার মৃত্যু ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনা চলছে। স্বর্ণময়ী বিশ্বাস নামের ২৮ বছর বয়সী ওই তরুণী 'আত্মহত্যা করেছেন' বলে ধারণা করছেন অনেকে।
আবার কেউ কেউ তার মৃত্যুর পেছনে 'অনেকাংশে দায় দেখছেন সংবাদমাধ্যমটির বাংলা কনটেন্ট এডিটর আলতাফ শাহনেওয়াজ নামে শীর্ষ এক কর্তার'—তার বিরুদ্ধে এর আগে 'যৌন নিপীড়ন', 'বাজে আচরণের' মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছিলেন স্বর্ণময়ীসহ ওই প্রতিষ্ঠানেরই ২৬ কর্মী।
ঢাকা স্ট্রিম গতকাল ওই নারীর নাম উল্লেখ করে বিবৃতিতে জানায়, তার মৃত্যুর সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। তিন মাস আগের অভিযোগকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
তবে আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ দেওয়ার পর সংস্থাটি কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ঢাকা স্ট্রিমের দাবি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির সম্পাদকের কাছে চিঠি লিখেছেন পাঁচ বিশিষ্ট নারী।
ঢাকা স্ট্রিমের সম্পাদক গোলাম ইফতেখার মাহমুদের বরাবর লেখা ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট সায়দিয়া গুলরুখ ও ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা।
চিঠিতে বলা হয়েছে, 'আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে আপনার নিউজপোর্টালে কর্মরত গ্রাফিক্স ডিজাইনার স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের আত্মহত্যার খবর জানতে পারি। একই সঙ্গে জানতে পারলাম যে স্বর্ণময়ী বিশ্বাস এবং আরও কয়েকজন নারী সহকর্মী আপনার কাছে বাংলা বিভাগের প্রধান আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন।'
'বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, উচ্চ আদালত থেকে ২০১০ সালে কর্মক্ষেত্রে যৌনহয়রানি প্রতিরোধ এবং অভিযোগ নিরসনের কতগুলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আপনার প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগ কর্তৃক প্রচারিত বিবৃতিটি পড়ার পর আমাদের মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে।'
চিঠিতে সেই প্রশ্ন তুলে বলা হয়, 'আমরা জানতে চাই, এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে আদালতের নির্দেশনা সাপেক্ষে আপনি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন? যেমন আমরা জানতে চাই যে বিবৃতিতে উল্লেখিত দুই সদস্যের তদন্ত কমিটিতে হাই কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী নারী-পুরুষের অনুপাত রক্ষিত হয়েছিল কি-না বা বহিঃস্থ সদস্য ছিলেন কিনা?'
'আরও প্রশ্ন জাগে যে তদন্ত কমিটির কার্যপরিধি (টার্মস অব রেফারেন্স) কী ছিল? কারণ অভিযোগ ছিল যৌন হয়রানির, 'অসৌজন্যমূলক' আচরণের নয়। অথচ আপনাদের বিবৃতিতে দেখছি তদন্ত কমিটি অসৌজন্যমূলক আচরণের' প্রমাণের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিয়েছে। আর শুধু বার্তাকক্ষ থেকে একজন বিভাগীয় প্রধানকে প্রত্যাহার করাটা যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আদৌ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ কিনা এ প্রশ্নও করতে হচ্ছে আমাদের। কারণ এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্তের নিয়ম থাকলেও আপনার প্রতিষ্ঠান যে তা করেনি সেটা আপনাদের বিবৃতি থেকে স্পষ্ট। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আমরা যা জেনেছি, তা বিবৃতির বক্তব্য এবং যৌন হয়রানি প্রশ্নে ঢাকা স্ট্রিমের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।'
'আপনাদের দাবি অনুযায়ী, গৃহীত পদক্ষেপের ব্যাপারে অভিযোগকারীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এ দাবির পক্ষে আপনাদের কাছে কোনো প্রমাণ আছে কিনা আমরা তা-ও জানতে চাই', আরও বলা হয় চিঠিতে।
ঢাকা স্ট্রিমের গতকালের বিবৃতিতে বলা হয়, আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ১৩ জুলাই অভিযোগ জমা পড়ে। পরে আলতাফ শাহনেওয়াজকে বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা হয় এবং অভিযোগ তদন্তে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে সহকর্মীদের সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের কিছু ক্ষেত্রে অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রমাণ পাওয়া সাপেক্ষে তাঁকে বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়। এসব সিদ্ধান্তে কর্মীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।