নির্বাচন: পুরোপুরি প্রস্তুত জামায়াত, এখনও প্রার্থী বাছাইয়ে বিএনপি, জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনে ব্যস্ত এনসিপি

আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ গুছিয়ে আসনভিত্তিক প্রার্থী তালিকা প্রায় চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি এখন পূর্ণমাত্রায় নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে। এদিকে বিএনপিও চলতি মাসের মধ্যেই প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগামী এক মাসের মধ্যে জেলা ও মহানগর পর্যায়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কাজ করছে বলে জানা গেছে।
জামায়াতে ইসলামী সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সক্রিয় করেছে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চেয়ে লিফলেট বিতরণ করছেন এবং ভোটারদের ভোটার নম্বরও পৌঁছে দিচ্ছেন।
প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের তুলনায় নির্বাচনী প্রস্তুতিতে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, চলতি মাসেই আসনভিত্তিক প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করে কেন্দ্র থেকে অনুমোদন দেওয়া হবে। দলের ভেতরে একাধিক প্রভাবশালী নেতার প্রার্থিতা আকাঙ্ক্ষা, অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং ও কোন্দলের কারণে প্রস্তুতির গতি কিছুটা কমে গেছে।
অন্যদিকে, জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের গড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো পুরোপুরি সংগঠিত হতে পারেনি। দলটি নিবন্ধন প্রক্রিয়া, গঠনতন্ত্র চূড়ান্তকরণ এবং প্রতীক নির্ধারণের মতো বিষয়গুলো নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তায় রয়েছে।
জামায়াত পুরোপুরি নির্বাচনী মাঠে
রাজধানীর কয়েকজন ভোটার জানিয়েছেন, জামায়াতের কর্মীরা তাদের বাসায় গিয়ে ভোট চেয়েছেন এবং ভোটার নম্বরও দিয়েছেন। তবে এখনো বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেননি। একইভাবে জনসমাগম হয়—এমন স্থানে ব্যানার ও বিলবোর্ড বসিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে জামায়াত। বিএনপি, এনসিপি বা অন্য কোনো দলের এমন কার্যক্রম এখনো চোখে পড়েনি।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালালেও গত বছরের নভেম্বর থেকে ধাপে ধাপে প্রায় ৩০০ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে জামায়াত। ঘোষিত প্রার্থীরা ইতোমধ্যেই নিজ নিজ এলাকায় প্রচারণা শুরু করেছেন।
জামায়াতের একটি সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নির্বাচনী সেল গঠন করা হয়েছে। সেলটি প্রার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে পরামর্শ, দিকনির্দেশনা এবং প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পাশাপাশি আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা টিমও গঠন করা হয়েছে।
নির্বাচনী এলাকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর কাজ করছে দলটি। তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতেও নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের টিবিএসকে বলেন, "প্রায় এক বছর আগে থেকেই আমরা ধাপে ধাপে প্রার্থী ঘোষণা শুরু করেছি। প্রায় সব আসনে প্রার্থী নির্ধারণ করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছি। কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা বিভাগ থেকে সবকিছু মনিটর করা হচ্ছে।"
প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, "প্রতিটি আসনের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতামত নেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন, থানা, উপজেলা ও জেলা নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে থেকে তিনজনের একটি প্যানেল তৈরি করে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডে পাঠানো হয়। ওই প্যানেল থেকেই একজনকে চূড়ান্ত করা হয়েছে।"
বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে
দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা ও দ্বিধায় রয়েছেন বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রচার-প্রচারণা চালালেও কেন্দ্রীয় মনোনয়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
তাদের অভিযোগ, ব্যক্তিগতভাবে বহু নেতা প্রচারে এগিয়ে থাকলেও দলীয়ভাবে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনী প্রস্তুতিতে অনেক এগিয়ে গেছে।
আসনভিত্তিক একাধিক প্রার্থী থাকায় বিএনপির পক্ষে প্রচারণা আরও তীব্র হচ্ছে বলে মনে করছেন নেতারা। দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম টিবিএসকে বলেন, "গত ১৭ বছর ধরে বিএনপি মাঠে আছে, জনগণের মধ্যেই ছিল। এর মধ্য দিয়েই আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছি। একেক আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকায় প্রচারণা আরও সক্রিয় হয়েছে।"
মনোনয়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও প্রার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে মাঠে কাজ করছেন। সিলেট-৬ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ও জেলা বিএনপির সদস্য ফয়সাল আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "২০১৮ সালে আমি নির্বাচন করেছি। তাই শুরু থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।"
তিনি আরও বলেন, "প্রতিদিন জনসভা, উঠান বৈঠক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেডিকেল ক্যাম্প, পথসভা, কর্মীসভা করছি। বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে নিয়মিত কাজ করছি।"
সুনামগঞ্জ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী যুবদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, "দীর্ঘ সময় আমরা আন্দোলন করেছি, জনগণের সঙ্গে ছিলাম। এখন রোডম্যাপ অনুযায়ী একের পর এক গ্রাম ঘুরছি, ভোটারদের কাছে যাচ্ছি। ধানের শীষের পক্ষে প্রচারণা চলছে জোরেশোরে। প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই, জনগণও ভোট দিতে উদ্গ্রীব।"
জানা গেছে, চলতি মাসের মধ্যেই আসনভিত্তিক একক প্রার্থীকে 'গ্রিন সিগন্যাল' দেবে বিএনপি। গত সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এর আগে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেছিলেন, "বিএনপি একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দল। প্রতিটি আসনে আমাদের একাধিক যোগ্য প্রার্থী আছেন—অনেক আসনে ১০ থেকে ১২ জন পর্যন্ত রয়েছেন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ চলছে। খুব শিগগির একক প্রার্থীকে মাঠে নামানোর জন্য গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হবে।"
এনসিপির নির্বাচনী প্রস্তুতি
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচনী প্রস্তুতি গোছাতে বিভাগভিত্তিক সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছে। প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের এক মাসের মধ্যে জেলা ও মহানগর পর্যায়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ১০ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে অন্যান্য দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তাদের মধ্যে রয়েছেন—রংপুরে ড. আতিক মুজাহিদ, রাজশাহীতে ইমরান ইমন, সিলেটে এহতেশাম হক, ময়মনসিংহে আশেকিন আলম, ঢাকায় সাইফুল্লাহ হায়দার, ফরিদপুরে নিজাম উদ্দীন, চট্টগ্রামে এস এম সুজা উদ্দিন, কুমিল্লায় মো. আতাউল্লাহ, খুলনায় ফরিদুল হক এবং বরিশালে অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন।
ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাইফুল্লাহ হায়দার টিবিএসকে বলেন, "ইতোমধ্যে আমাদের ৫০টির বেশি উপজেলা কমিটি গঠিত হয়েছে। মানিকগঞ্জ ও নরসিংদীসহ কয়েকটি জেলায় অফিসও হয়েছে। নিবন্ধনের আগ থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতি সক্রিয়ভাবে চলছে।"
তিনি আরও বলেন, "রংপুর বিভাগেও আমাদের কার্যক্রম দ্রুত এগোচ্ছে।"
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার টিবিএসকে বলেন, "আমাদের নির্বাচনী মূল্যায়ন (অ্যাসেসমেন্ট) চলছে সারাদেশে। দলের ভেতরেও আলোচনা হচ্ছে। এখনো কোনো জোটগত আলাপ শুরু হয়নি। প্রথমে আমরা একক সক্ষমতা যাচাই করছি। সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করার পর জোট নিয়ে ভাবা হবে।"
তিনি বলেন, "সব দলই নির্বাচনে জোটের চিন্তা করছে, আমরাও জোট গঠনের মাধ্যমেই অংশ নিতে চাই।"
দলটির কয়েকজন সদস্য জানান, নির্বাহী কমিটিতে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হলেও সাধারণ সভায় এখনো বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি। আগামী সপ্তাহে এসব বিষয়ে সভায় বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে।
এদিকে, গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর দলীয় প্রতীক 'শাপলা' দাবি প্রসঙ্গে এনসিপির প্রধান সমন্বয়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী টিবিএসকে বলেন, "শাপলা প্রতীক ছাড়া আমরা কোনোভাবেই নিবন্ধন নেব না। ওই প্রতীক না পেলে নির্বাচনে অংশগ্রহণেরও কোনো অর্থ নেই।"