ওমান ট্র্যাজেডি: দুখুমের সিদ্দাতেই কেন মারা যাচ্ছেন সন্দ্বীপের প্রবাসী বাংলাদেশিরা

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের দুখুম সিদ্দা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় সাত বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনাটি নতুন নয়। একই স্থানে এর আগেও একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবারই এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশিরা—যাদের অধিকাংশের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়।
প্রশস্ত হাইওয়েতে উচ্চগতির যান চলাচল, এবং অবৈধভাবে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকায় যানবাহনের চালকরা পুলিশ আতঙ্কে থাকেন; এ দুটি কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বুধবার (৮ অক্টোবর) বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪টার দিকে ওমানের দুখুম এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় সন্দ্বীপ উপজেলার সাত জন মারা যান। তারা সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার শিকার হন। এর আগে ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় সন্দ্বীপের পাঁচ প্রবাসী নিহত হয়েছিলেন। তারাও সবাই মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, সন্দ্বীপের দক্ষিণ অংশের অধিকাংশ মানুষ মৎস্যশিকারী, যারা জীবিকার জন্য সাগরে মাছ ধরেন। এখানকার অনেকে ওমানে প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে দোকান বা ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন।
দীর্ঘ ২৭ বছরের প্রবাস জীবন শেষে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে ফিরে সন্দ্বীপ উপজেলার পশ্চিম সারিকাইতে মুদির দোকান দেন সাহবউদ্দিন। তার দোকানের কাছেই বাড়ি নিহত মোহাম্মদ বাবলু ও মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিনের।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'এর আগেও দুটি দুর্ঘটনায় এখানকার মানুষ মারা গিয়েছিল। ২০২১ সালে একবার পাঁচজন, ২০১৬ সালেও তিনজন মারা গিয়েছিল। তাদের সবার বাড়ি সন্দ্বীপে। দুর্ঘটনায় পঙ্গু আনোয়ার হোসেন এখন ঠেলাগাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।'
তিনি আরও বলেন, 'ওমানের দুখুমে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিতদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশি। এর ৯০ শতাংশ সন্দ্বীপের মানুষ। দুখুমের মহাসড়কটি অনেক প্রশস্ত, আর সেখানে গাড়ি চলে অনেক গতিতে—এটিও দুর্ঘটনার কারণ।'
একই এলাকার প্রবাসী মোহাম্মদ আয়ুব খান টিবিএসকে বলেন, '২০০১ সাল থেকে আমি প্রায় ২০ বছর দুখুমে মাছ ধরার কাজ করেছি। এখনও আমার পরিবারের ১০ জন ওমানে আছেন, সবাই মাছ ধরেন। আমার বাবা, চাচারাও প্রবাসী ছিলেন।'
দুর্ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'ওমানে স্পিড বোটের মতো ছোট নৌযানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র নিবন্ধিত বড় নৌযানে মাছ ধরা যায়। কিন্তু বাংলাদেশিদের দিয়ে নিষিদ্ধ ছোট নৌযান চালানো হয়। এতে আমরা সবসময় এক ধরনের আতঙ্কে থাকি—কারণ পুলিশ ধরলে জেলে যেতে হয়। অনেকেই ঋণ করে এখানে আসে, তাই ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা বৈধভাবে বড় নৌযানে মাছ ধরার কাজে গেলেও ওমানি মালিকেরা আমাদের ছোট নৌযানে নামতে বাধ্য করেন। ওমান সরকারকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।'
সন্দ্বীপের মুছাপুরের প্রবাসী তারেকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'ছোট নৌযানে মাছ ধরা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও টাকাটা বেশি। ওমানে দোকান বা বাসাবাড়িতে কাজ করলে মাসে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পাওয়া যায়, কিন্তু মাছ ধরার কাজে দুই মাসে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা আয় হয়। তাই ঝুঁকি জেনেও অনেকে এই পেশা বেছে নেন।'
সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মংচিংনু মারমা বলেন, 'সন্দ্বীপের প্রায় এক লাখ মানুষ প্রবাসী, এর মধ্যে ৪০ হাজারেরও বেশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। আগের দুর্ঘটনাগুলোর বিষয়ে আগে জানতাম না। এখন যেহেতু জেনেছি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।'
ওমানে বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সেলর মো. রফিউল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'ওমানে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ বৈধ বাংলাদেশি আছেন। অনানুষ্ঠানিক হিসাবে এই সংখ্যা আট লাখের কাছাকাছি। কোন এলাকায় কতজন আছেন বা কোন পেশায় আছেন; সে তথ্যের জন্য আমরা ওমান সরকারকে বারবার চিঠি দিয়েছি। অনেকে এক কাজের ভিসা নিয়ে এসে পরে কোম্পানি বদলান, তখন দূতাবাসে রিপোর্ট করেন না। তাই তথ্য সবসময় হালনাগাদ থাকে না।'
তিনি আরও বলেন, 'একাধিক দুর্ঘটনার খবর আমার জানা নেই। আমি দায়িত্বে এসেছি বেশিদিন হয়নি। দুখুমের মহাসড়ক আট লেনের, সেখানে গাড়ি খুব দ্রুত চলে। ওমান সরকার গতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করছে। ছোট বা বড় নৌযানের বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। এখানে যিনি যে ভিসায় আসেন, তাকে সেই কাজই করতে হয়।'