সংসদীয় অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কা, দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট সংসদ বাতিলের সুপারিশ সিপিডির

বাংলাদেশে সংসদীয় জবাবদিহিতা বাড়ানোর জন্য প্রস্তাবিত সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের পরিকল্পনা বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি মনে করে, এই পদক্ষেপে কার্যকর কোনো পরিবর্তন আসবে না, বরং সংসদীয় কাঠামোয় অপ্রয়োজনীয় জটিলতা যুক্ত হবে।
আজ বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সিপিডি 'প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ কি জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারবে' শিরোনামে এক জাতীয় সংলাপ আয়োজন করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অংশগ্রহণে সেই অনুষ্ঠানে সংসদ দ্বিকক্ষ করার প্রস্তাব বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেই কমিশন ধারাবাহিক বৈঠকের পর গতকাল বুধবার জানায়, তারা দু-এক দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। এই প্রতিবেদনে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা থাকছে। কারণ, দলগুলো এতে একমত হয়েছে বলে আগেই জানানো হয়।
কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার ঠিক আগে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার দুর্বলতা, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সংসদে জবাবদিহির পদ্ধতি, সংসদীয় ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে বৈশ্বিক উদাহরণগুলো বিশ্লেষণ করে বৃহস্পতিবারের সংলাপে একটি গবেষণা প্রতিবেদন উত্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নিজাম আহমদ।
মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের সংসদীয় ব্যবস্থায় দ্বিতীয় কক্ষ গঠনের কোনো যুক্তি বা প্রয়োজনীয়তা নেই।
তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উচিত সংসদীয় কাঠামোয় বাস্তব সংস্কার নিয়ে আলোচনা করা, অপ্রয়োজনীয়ভাবে নতুন কক্ষ গঠনের উদ্যোগ নিয়ে নয়। উচ্চকক্ষের বদলে 'পার্লামেন্ট কমিশন' গঠন করা যেতে পারে, যা সংসদের 'তৃতীয় চোখ' হিসেবে কাজ করবে।
নিজের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে তিনি বলেন, "স্পিকার অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় সিদ্ধান্তে নিজেকে অসহায় বোধ করেন। একটি পৃথক কমিশন স্পিকারকে শক্তিশালী করবে এবং সংসদের কার্যকারিতা বাড়াবে।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশের ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির পার্লামেন্টে জবাবদিহিতা প্রায় অনুপস্থিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই আইন প্রণয়নে পুরোপুরি প্রাধান্য বিস্তার করে—প্রায় ৯৯ শতাংশ আইন তাদের ইচ্ছামতো পাস হয়।"
ড. মোয়াজ্জেম জানান, সংসদে প্রায় ৫০টি কমিটি থাকলেও সেগুলোর অধিকাংশই কার্যকরভাবে কাজ করে না। "যদি এসব কমিটি প্রকৃত অর্থে সক্রিয় হতো, তবে আইন প্রণয়নে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জবাবদিহিতা তৈরি হতো। তাই বর্তমান কাঠামোর মধ্যেই জবাবদিহিতা জোরদার করা সম্ভব, নতুন উচ্চকক্ষের কোনো প্রয়োজন নেই।"
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ধারণার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ মন্তব্য করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ১৮৬২ সালের বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের সংবিধান পর্যন্ত এই ভূখণ্ড একটি ভাষা ও সংস্কৃতিগতভাবে একক ও সমজাতীয় সমাজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাই ঐতিহাসিকভাবে একক সংসদই এখানে প্রাসঙ্গিক ছিল।
বাংলাদেশে সংসদের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এটি আইন প্রণয়নের আসল ক্ষেত্র না হয়ে কেবল আইন পাসের স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার সংসদে বেসরকারি বিল পাস করার সুযোগ থাকলেও সেটি রাজনৈতিক বাধা, দলীয় চাপ ও জটিল সংসদীয় প্রক্রিয়ার কারণে করা যায় না। এ অবস্থার পেছনে রাজনৈতিক বাধা, দলীয় চাপ এবং জটিল সংসদীয় প্রক্রিয়া দায়ী। এমনকি যখন বিল সংসদে যায়, কমিটিতে তা রেফার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংশোধন সীমিত থাকে শব্দ বা অনুচ্ছেদ বদলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গুণগত আলোচনা অনুপস্থিত থাকে।
তদারকির ক্ষেত্রেও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সংসদীয় তদারকি হওয়ার কথা তিনটি স্তরে—আইন প্রণয়ন, বাজেট ও সাধারণ তদারকি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব প্রায়ই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র; সেখানে নির্বাচিত প্রশ্নগুলোই আসে, সমালোচনামূলক আলোচনা নয়। সংসদের ৫০টির বেশি কমিটি থাকলেও নিয়মিত বৈঠক হয় না; পাঁচ বছরে প্রয়োজনীয় ৩ হাজার বৈঠকের বিপরীতে বছরে গড়ে ১২টি বৈঠক হয়। ফলে কার্যকর জবাবদিহি গড়ে ওঠে না।
এই দুর্বল কাঠামোর মধ্যে দ্বিকক্ষের মতো নতুন কোনো সংসদীয় কাঠামো চালু করলেও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে না বলে মনে করেন গোলাম মোয়াজ্জেম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজাম আহমদ বলেন, আপার হাউস গঠনের যৌক্তিকতা দুর্বল ও আশ্বাসজনক নয়।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী নিম্নকক্ষ থেকে পাস হওয়া বিলগুলো পর্যালোচনার জন্য উচ্চকক্ষে পাঠানো হবে, কিন্তু উচ্চকক্ষের কোনো সংশোধনী ক্ষমতা থাকবে না। "যদি আপার হাউস শুধু সুপারিশ করতে পারে, তবে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে কীভাবে?"—তিনি প্রশ্ন তোলেন।
তিনি আরও বলেন, নিম্নকক্ষ সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হলেও উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সদস্য মনোনয়ন হবে, যেখানে বিরোধী দলের প্রভাব কিছুটা বাড়তে পারে। "দুই কক্ষের মধ্যে ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা করা হবে, সেটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।"
অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলিম আংশিকভাবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পক্ষে যুক্তি দেন। তার মতে, "দ্বিতীয় কক্ষ থাকলে শাসক দল স্বৈরতান্ত্রিকভাবে আচরণ করতে পারবে না। এটি ন্যাচারালি এক ধরনের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা সৃষ্টি করবে।"
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, "এটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও কাজের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি বাড়াতে পারে।"
সংলাপে উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য দেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে শেখ হাসিনা 'দানবে' পরিণত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে উচ্চকক্ষ থাকলে এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকলে বিএনপি কমপক্ষে ৯৩টি সংসদীয় আসন পেত। আওয়ামী লীগ পেত ১৪৪টির মতো। যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হলো, উচ্চকক্ষ থাকলে সেটি পাস করা কঠিন হতো।
সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান। তিনি বলেন, সংসদে জবাবদিহিতা বাড়াতে হলে প্রথমে বিদ্যমান ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো চিহ্নিত ও সংশোধন করা জরুরি।
"সংসদ সদস্যদের আচরণবিধি (কোড অব কনডাক্ট) প্রণয়নই হতে পারে জবাবদিহিতা বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায়,"—তিনি মন্তব্য করেন।