জুলাই সনদ বাস্তবায়নে অচলাবস্থার মধ্যেই আজ আবারও ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রথম ধাপে ৪৪টি এবং দ্বিতীয় ধাপে ২৩টি বৈঠক শেষে আজ রোববার (৫ অক্টোবর) সকালে তৃতীয় ধাপের আলোচনার চতুর্থ দিনের বৈঠক শুরু করবে।
এদিন কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত শুনে নিজেদের প্রস্তাব উপস্থাপন করবে। বৈঠকের আগে কমিশন সদস্যদের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, "২০ দিনের ব্যবধানে বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আশা করছি দলগুলো এবার মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে আরও কাছাকাছি অবস্থানে আসবে। আমরা আশা করছি আগামীকালের (আজকের) বৈঠকেই বিষয়গুলো সুরাহা হবে। তবে প্রয়োজন হলে আরও একদিন বৈঠক হতে পারে।"
কমিশন ঐকমত্যের বিষয়ে আশাবাদী হলেও দলগুলো এখনো নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছে। অনানুষ্ঠানিক বৈঠকগুলোতেও কাঙ্ক্ষিত সমঝোতা হয়নি।
দলগুলো ঐকমত্যে না পৌঁছালে কমিশন কীভাবে সুপারিশ দেবে—এমন প্রশ্নে অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, "আমরা ১০ অক্টোবরের মধ্যে সরকারের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে তিনটি সুপারিশ পাঠাবো। এগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এবং বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পরামর্শ মিলিয়ে তৈরি করা হবে।"
দলগুলোর অনড় অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "দলগুলো বাইরে কী বলছে তা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ; তবে আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কমিশনের বৈঠকে তারা কী মতামত দিয়েছে।"
কমিশন নতুন কোনো প্রস্তাব দেবে কি না—জানতে চাইলে অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, "প্রথমে আমরা দলগুলোর মতামত নেবো। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মিলিয়ে প্রস্তাব দেওয়া হবে।"
সূত্র জানায়, বিএনপি ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার পক্ষে, জামায়াত সংবিধান আদেশ জারির প্রস্তাবে অটল, আর এনসিপি গণপরিষদ গঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কমিশন তিনটি প্রস্তাবই সমন্বয়ের চেষ্টা করছে।
শনিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দীন আহমেদ বলেন, "আইন ও সংবিধান অনুযায়ী বৈধ প্রক্রিয়া ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তনের কোনো অধিকার কারও নেই।"
তিনি আরও বলেন, "জনগণের অভিপ্রায় থেকেই এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—এটা সত্যি। কিন্তু সেই অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছে, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আওতায় যেতে হয়েছে। আমরা সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন ও উপদেষ্টাদের শপথ দেখেছি। সেটিকেই আমরা বৈধ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখি।"
সালাউদ্দীন বলেন, "এখন আলোচনা হচ্ছে—জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নাকি আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন চলছে। তবে সংবিধান সংশোধনের অংশগুলো বাস্তবায়নে পরবর্তী সংসদের প্রয়োজন, কারণ তা সম্পূর্ণ সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই করতে হবে। এসব অংশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পরবর্তী জাতীয় সংসদকেই নিতে হবে।"
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মহাসচিব মিয়া গোলাম পরওয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা আশাবাদী জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য আসবে। অনেক দলের সঙ্গেই আমাদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। আশা করছি, আগামীকাল (আজ) বৈঠকে আমাদের প্রতিনিধি দল অংশ নেবে এবং সেখানেই আলোচনার অগ্রগতি বোঝা যাবে।"
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির সংস্কার সমন্বয় কমিটির সদস্য ও যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, "সব দল যদি ঐক্যের স্বার্থে এক জায়গায় আসে, তাহলে আমরাও ছাড় দিতে প্রস্তুত। তবে গণপরিষদ ও নতুন সংবিধান আমাদের রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশ। ক্ষমতায় এলে সেটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।"
তিনি আরও বলেন, "এখনও পর্যন্ত দলগুলোর মধ্যে কোনো অনানুষ্ঠানিক সমঝোতা হয়নি। ফলে ব্যক্তিগতভাবে মনে হচ্ছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে।"
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-এর নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, "আমরা বড় দলগুলোর সঙ্গেও অনেকবার আলোচনা করেছি, কিন্তু কোনো সমঝোতা হয়নি। ঐকমত্য কমিশনের নামে এখন আসলে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে, এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "তারা যে ৮৪ বিষয়ে ঐকমত্যের কথা বলছে, সেখানেই অনেক দলের ঘোর বিরোধিতা ও 'নোট অব ডিসেন্ট' রয়েছে। কেউ ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাচ্ছে, কেউ গণভোট বা সংবিধান আদেশের কথা বলছে—ভিত্তি না রেখেই কমিশন অহেতুক আলোচনা চালাচ্ছে।"
"আমার মনে হয় না সবাই একমত হবে। বৈঠকের নামে জনগণকে নির্বাচনমুখী আলোচনা থেকে অন্যদিকে সরানো হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।