বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালতের খসড়ায় জেলা পর্যায়ে ৯০ দিনে মামলা নিষ্পত্তির প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্টের
বাণিজ্যিক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য 'বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত' গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের তত্ত্বাবধানে আইনের একটি খসড়া প্রস্তুত করে সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্ট থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে খসড়াটি নিয়ে কাজ করছে। দ্রুত প্রণয়নের লক্ষ্যে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতির সম্মতিতে অধ্যাদেশ আকারে এটি জারি হতে পারে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, ব্যবসায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, বিমান ও নৌপরিবহন, নির্মাণ ও অবকাঠামো প্রকল্প, ফ্র্যাঞ্চাইজ চুক্তি, বিতরণ ও লাইসেন্সিং, প্রযুক্তি উন্নয়ন, ট্রেডমার্ক, কপিরাইট, পেটেন্ট, শিল্প নকশা, ডোমেইন নাম, ভৌগোলিক নির্দেশক, বীমা, অংশীদারিত্ব চুক্তি, পরিষেবা খাত ও শেয়ারহোল্ডার বা যৌথ উদ্যোগসংক্রান্ত বিরোধ এ আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে থাকবে।
প্রতিটি জেলায় একজন জেলা জজের নেতৃত্বে এক বা একাধিক বাণিজ্যিক আদালত গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। পাশাপাশি হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে পৃথক বাণিজ্য বেঞ্চ করার কথাও বলা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে মামলা ৯০ দিনের মধ্যে, হাইকোর্টে ছয় মাসে এবং আপিল বিভাগে তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়েছে।
এদিকে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের 'ইজ অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স' প্রতিবেদনে ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে ১৯০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৮তম। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি দীর্ঘসূত্রতার কারণেই বাংলাদেশের অবস্থান এ সূচকে এত নিচে।
সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, নতুন আইন প্রণয়ন করে বাণিজ্যিক আদালত গঠন করা হলে আধুনিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত প্রায় সব ধরনের বিরোধ একটি বিশেষায়িত আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির সুযোগ তৈরি হবে।
প্রস্তাবে মামলা দায়েরের আগে মধ্যস্থতাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের মতে, এর ফলে অনেক বিরোধ আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হবে এবং আদালতের উপর মামলার ক্রমবর্ধমান চাপ কমে আসবে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো বাণিজ্যিক মামলা বা আবেদনের মূল্যমান ৫০ লাখ টাকা হলে তা বাণিজ্যিক আদালতে বিচার্য হবে। এর বেশি অঙ্কের মামলা হাইকোর্টে করা যাবে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী সরকার সময়ে সময়ে এই সীমা পরিবর্তন করতে পারবে।
দ্রুত ও কার্যকর বিচার নিশ্চিত করতে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, চূড়ান্ত শুনানি ৯০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব এড়াতে সংক্ষিপ্ত বিচারের সুযোগ রাখা হয়েছে। আপিল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে—বাণিজ্যিক আপিল আদালত ছয় মাসের মধ্যে এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেবে।
এছাড়া বাণিজ্যিক আদালত কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, বিচারক ও আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ এবং ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়নের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট জানায়, আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর আগে অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এ বছর ময়মনসিংহ, রংপুর ও খুলনায় সুপ্রিম কোর্ট ও ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত "জুডিশিয়াল ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যান্ড এফিসিয়েন্সি ইন বাংলাদেশ" শীর্ষক আঞ্চলিক সেমিনারে বিচারক, আইনজীবী ও উন্নয়ন সহযোগীদের অংশগ্রহণে বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠায় করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
এছাড়া ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা)-র যৌথ উদ্যোগে রাজধানীতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে আরেকটি সেমিনার হয়। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর ১৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট ও ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগে সিলেটে একটি বিশেষ সেমিনার আয়োজিত হয়, যেখানে টেকনিক্যাল ও প্লেনারি সেশনে অংশীজনরা বাণিজ্যিক আদালত গঠনের প্রস্তাব নিয়ে মতামত দেন।
এসব মতামত বিবেচনা করেই প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
